বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইউসুফের স্মৃতিচারন
![]()
পারভেজ হায়দার
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে, প্রথমেই উঠে আসে বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। মোঃ ইউসুফের মতো বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে টিকে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি জীবনের শুরুর দিকটা ছিলো দেশকে স্বাধীন করার অদম্য স্পৃহা। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইউসুফ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তবে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাথে সংশ্লিষ্টতার সুযোগ তার আগে থেকেই হয়েছিলো। তার বাবা ১৯৬৫ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন। মোঃ ইউসুফের ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথানেও অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমানে তিনি পানছড়িতে থাকেন। সাউথইস্ট জার্নালের সম্পাদক পারভেজ হায়দারের সাথে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে। সেই কথোপকথনের অংশ বিশেষ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় বা এর আগে আপনি কি করতেন?
মোঃ ইউসুফ- মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছাত্র ছিলাম। এর আগে ১৯৬৯ সাল থেকে আমি ছাত্রলীগ করতাম। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি নবীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক হোসেন, যিনি পরবর্তীতে একসময় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এবং দুই বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। সেসময় আমি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম.

সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি কিভাবে, কোথা থেকে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?
মোঃ ইউসুফ- ৭১ এ আমি ও আমার সাথের ছাত্রলীগ নেতারা সেসময় রাঙ্গামাটির কাপ্তাই থেকে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনে “যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো”এমন নির্দেশনা শোনার পর আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা ঐ সময়ে কখন কি ঘটছে, কি সম্যা হচ্ছে তা নিয়ে তৎপর ছিলাম। ২৫শে মার্চ রাতে রেডিওর মাধ্যমে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সংবাদ মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছিলাম কি হচ্ছে বা কি হতে চলেছে । পরবর্তীতে রাত আনুমানিক বারোটার পর চট্টগ্রাম হতে আমাদের কাছে সংবাদ আসলো, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কেমন ছিলো সেসময়কার পরিস্থিতি?
মোঃ ইউসুফ- পাকিস্তার আর্মির এক মেজরসহ পাকিস্তানী সৈন্যরা কাপ্তাই প্রজেক্টের ভেতরেই অবস্থান করছিলো। সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের আলী আকবর নামের একজনকে পাকিস্তানীরা ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলে। এর সূত্র ধরেই আমি, নবীর হোসেন, সাদেক হোসেনসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও ক্যাপ্টেন হারুন সহ স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীরা কালুরঘাট গিয়ে ট্রান্সফর্মার খুলে ট্রাকে ফিটিং করে ২৭ তারিখে সবাই একসাথে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে। ২৩শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ প্রায় ১৯দিন ধরে চলে। এরপর যে যেখানেই ছিলো সবাই মোটামুটি সতর্কাবস্থায় ছিলাম।
আমরা তৎকালীন ছাত্রলীগের কর্মীরা দেশাত্ববোধকে ধারণ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে তখনকার সময় পতেঙ্গা থেকে ফেরার পথে ৩০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে বর্তমান কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়েছিলাম। শুরু হয় নতুন করে যুদ্ধ, পাকিস্তানী সৈন্যরাও স্টিমার থেকে অনবরত ফায়ারিং চালাতো। এসময় পাকিস্তানীদের হাতে মেজর কাশেম নিহত হন। ১৩ দিন পর ৭০এর নির্বাচনে বিজয়ী পটিয়ার এমপি আবু সালেহ’র নেতৃত্বে আমরা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনতা গণলাইন তৈরী করে যুদ্ধে যেতে আগ্রহীদের চট্টগ্রামে পদুয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের দেমাগ্রীতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠিয়েছিলাম। সেসময় তাদের সাথে ৭০ এর নির্বাচনের সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা এমএ মান্নানও ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যায়ক্রমে ডেকেছিলেন। তিনি সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছিলেন, “যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ, তোমাদের আমার হৃদয়ের ভালবাসা ছাড়া দেবার মতো আর কিছুই নেই।” বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর কণ্যা শেখ হাসিনা তার সময়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট সম্মান দিয়েছেন।
যুদ্ধের সময় আমি প্রায় সময়ই কাটিয়েছি পার্বত্য চট্টগ্রামে। তৎকালীন সময়ে মং সার্কেল ও বোমাং সার্কেলের ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের কিছু লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করলেও চাকমা সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই ছিলো পাকিস্তানপন্থি রাজাকার। পরবর্তীতে এসব রাজাকারদের দিয়েই শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগঠন শুরু হয়। বর্ডার কাছে থাকায় যুদ্ধকালীন সময়ে খাগড়াছড়ির রামগড় ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের চারণ ভূমি। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন বাঁশের ভেতর ও কলাপাতায় খাবার খেতে পারা এবং পাহাড়ী রাস্তায় চলাচল করতে পারাসহ নানা কারণে উক্ত সময়ে ভারতের লে. জেনারেল শর্মা বলেছিলেন, গেরিলাদের জন্য সর্বোচ্চ ঘাঁটি পার্বত্য চট্টগ্রাম।
সাউথইস্ট জার্নাল- শান্তিবাহিনীর জন্ম কিভাবে হলো?
মোঃ ইউসুফ- এমএন লারমা তৎকালীন চাকমা রাজাকারদের নিয়ে এবং তাদের কাছে থাকা অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে রাঙ্গামাটি বর্তমান উন্নয়ন বোর্ডের মাঠে সভা করে শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত রাজাকারদের জন্য পাকিস্তানীদের আনা অস্ত্র দিয়েই শান্তিবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় মিজো বাহিনী পাকিস্তানের পক্ষে পাহাড়ে কেমন কাজ করেছিলো?
মোঃ ইউসুফ- পাকিস্তানীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে মিজোরামের মিজো বাহিনীই পথ দেখিয়েছে এবং তাদের সহায়তা করেছে, মিজোরা না থাকলে পাকিস্তানীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে সহিংসতা চালানোর সুযোগ ততটা পেতো না। বিপরীতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে তিব্বতি সৈন্যরা বাংলাদেশে পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ করেছে।
সাউথইস্ট জার্নাল- এমএন লারমা বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন কেন?
মোঃ ইউসুফ- বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে এমএন লারমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাকশালে যোগ দিতে, তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গভর্ণর নিযোগ দিবেন। সেই লোভে পড়েই বঙ্গবন্ধুকে সেসময় কথা দিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েও এমএন লারমা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেখান থেকে সরে গিয়ে শান্তিবাহিনীতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন।
সাউথইস্ট জার্নাল- বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে শান্তিবাহিনীর সৃষ্টি বা এমন পরিস্থিতি হতো বলে মনে করেন?

মোঃ ইউসুফ- বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে শান্তিবাহিনীর সৃষ্টি হতোনা বলে আমি মনে করি, এছাড়া বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো এমএন লারমা বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতো, এসব শান্তিবাহিনী বা এত সহিংসতা হতো না পাহাড়ে।
সাউথইস্ট জার্নাল- বোমাং রাজার অনুসারীরা কি রাজাকার ছিলেন?
মোঃ ইউসুফ- বান্দরবানের বোমাং রাজা বা তার অনুসারীরা আসলে ততটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না আবার রাজাকারও ছিলোনা, তারা মোটামুটি মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করতো।
সাউথইস্ট জার্নাল- কাপ্তাই বাঁধ নির্মানের সময় ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারকে বাঁধা দেয়নি কেন?
মোঃ ইউসুফ- তৎকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকার আমেরিকার সহায়তায় কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ায় পার্বত্যবাসীর জন্য উপকার হয়েছে। আর তখন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে জিজ্ঞাসা করে ও তার পরামর্শ নিয়েই কাপ্তাই বাঁধ দেওয়া হয়েছিলো। এর ফলে পাহাড়ীদের বিভিন্ন লোকালয়ে সরকারী পূনর্বাসন হয়েছে, বাঙ্গালীদেরও পাহাড়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উপজাতিদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ হয়েছে।
সাউথইস্ট জার্নাল- ত্রিদিব রায় কি তৎকালীন সময়ে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন?
মোঃ ইউসুফ- হ্যাঁ, তৎকালীন সময়টাতে রাজাকার ত্রিদিব রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মানের বিরোধী ছিলো, তবে পরবর্তীতে কিছুটা নমনীয় হয়েছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- মিজোরা বাংলাদেশ থেকে কবে নিজ দেশে ফেরত গেলো?
মোঃ ইউসুফ- মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপরই পাকিস্তানীদের আত্নসমর্পনের সময় মিজোরা জঙ্গলের পথ ধরে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছিলো।
সাউথইস্ট জার্নাল- রাজাকার বা মিজোরা না থাকলে কি পাকিস্তানীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারতো?
মোঃ ইউসুফ- মিজোরা না থাকলে পাকিস্তানীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকে সহিংসতা চালানোর সুযোগ ততটা পেতো না। যুদ্ধের সময় মিজোরা নিজেদের চায়না বুদ্ধিষ্ট পরিচয় দিয়ে নানা অপকর্ম করতো।
সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের আগে ৬৬ বা ৬৯ এ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের ভূমিকা কেমন ছিলো?
মোঃ ইউসুফ- মুক্তিযুদ্ধের আগে ৬৬ বা ৬৯ এ পার্বত্য চট্টগ্রামেরর পাহাড়ীদের তেমন কোন ভূমিকা ছিলোনা।
সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কেমন ছিলো?
মোঃ ইউসুফ- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মং সার্কেলের অধিকাংশ পাহাড়ী ও বোমাং সার্কেলের স্বল্প সংখ্যক পাহাড়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও চাকমা সার্কেলের পাহাড়ীরা তেমন একটা যু্দ্ধে অংশ নেয়নি।
সাউথইস্ট জার্নাল- পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর কি কি ভূমিকা ছিলো?
মোঃ ইউসুফ- বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের মাত্র ৩ বা সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে স্বপরিবারে নিহত হয়েছেন। তবে এ অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা, রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অবকাঠামোসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন প্রকার সহিংসতা সৃষ্টি হতোনা। তিনি তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করতে পারতেন। সাধারণ পাহাড়ীরা তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের সূচনা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই শুরু হয়েছিলো। স্বার্থান্বেষী মহলের নানা অপপ্রচার থাকলেও ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচিত হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম নিশ্চই সেই মহান নেতার ভূমিকা মূল্যায়ন করবে এবং তার আদর্শকে ধারণ করবে।