মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ- বকুল চন্দ্র চাকমার বিশ্লেষণ - Southeast Asia Journal

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ- বকুল চন্দ্র চাকমার বিশ্লেষণ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

পারভেজ হায়দার

খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বকুল চন্দ্র চাকমা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালীন সময়ে একজন সচেতন দেশপ্রেমিক হিসেবে খুব কাছে থেকে সার্বিক ঘটনা প্রবাহগুলো দেখেছেন। সাউথইস্ট জার্নালের সম্পাদক পারভেজ হায়দারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ন বিষয়াদি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানা একান্ত প্রয়োজন। বকুল চন্দ্র চাকমা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাউথইস্ট জার্নালের কাছে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপরিবারে মর্মান্তিক হত্যার পর থেকেই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উঠে-পড়ে লেগেছিলো ইতিহাস বিকৃতির জন্য; তারা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে নেতিবাচক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। সাউথইস্ট জার্নালের গবেষণা ও সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদন সমূহের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ পাবে। বকুল চন্দ্র চাকমার সাথে আলাপচারিতার কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলো-

সাউথইস্ট জার্নাল- আপনি কোথায় পড়ালেখা করেছেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- আমি বকুল চন্দ্র চাকমা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান পানছড়ি। আমার জন্ম পানছড়ি উপজেলার লোগাং এলাকায়, আমি পুজগাং হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছি। পরবর্তীতে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে সেখানে পড়ালেখা করেছি।

সাউথইস্ট জার্নাল- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ৬দফা আন্দোলনের সময় সারাদেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কেমন ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- তখন আমি পানছড়ি জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ১৯৬৯ সালে সর্বপ্রথম পানছড়িতে আন্দোলনের হাওয়া লাগে। তখন সর্বপ্রথম রাঙ্গামাটিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়, সেখানে চট্টগ্রামের ছাত্ররাও ছিলো। ওদের মধ্যে রাঙ্গামাটির আশ্রাফ, অশোক মিত্র কার্বারী, অংগ্যজয় বাবু, প্রীতি কুমার ও তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একান চন্দ্র চাকমাও ছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সকল পাহাড়ী নেতাদের কথা আপনি বললেন, তৎকালীন সময়ে তারা কোন দল করতেন? এমএন লারমা কি তখন ছিলেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তবে এমএন লারমা ছিলেন না। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- ৬৯ এর গণঅভ্যুথানের সময় পার্বত্য অঞ্চলে কি প্রভাব পড়েছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো এবং সেখানে ছাত্র ও জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখানে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একান চন্দ্র চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন রাঙামাটি থেকে আসা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অশোক মিত্র কার্বারী, আশ্রাফ, প্রীতি কুমার ও পানছড়ি হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী রাজ কুমার চাকমা (পানছড়ি উপজেলা পরিষদের ১ম চেয়ারম্যান)। ৬৯ এর গণ অভ্যুথানে পাহাড়ে বেশীরভাগ আন্দোলন ছিলো স্কুল ভিত্তিক। নেপথ্যে স্কুল শিক্ষকরাও ছিলেন। শিক্ষকরা রেডিওতে খবর শুনে ছাত্রদের কর্মসূচীগুলো জানিয়ে দিতেন। ছাত্ররা সে হিসেবে মিছিল-মিটিং ও হরতালে পিকেটিং করতো। পানছড়ি হাইস্কুল এবং পুজগাং জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্ররা মিছিল সহকারে গিয়ে লোগাং পুলিশ ক্যাম্পেও কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- তখন চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় কোন পক্ষে কাজ করতেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- তখনকার সময় ত্রিদিব রায়ের কথা তেমন স্মরন নেই তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ কোন পক্ষে ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- ৬৯/৭০ এর আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশীরভাগ মানুষই বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো। তবে ত্রিদিব রায়ের তেমন কোন ভূমিকা ছিলো না।

সাউথইস্ট জার্নাল- দেশ স্বাধীন হবার পর এমএন লারমা কয়েকজন পাহাড়ী নেতৃবৃন্দসহ ৭২সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে ৪টি দাবি জানিয়েছিলো। এসব দাবি কি এর আগেও কোথাও করেছিলো নাকি সেবারই প্রথম ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- ৭২ সালে এমএন লারমা স্বায়ত্বশাসন নিয়ে দাবি জানিয়েছিলো, যা এর আগে তিনি কোথাও, কারো কাছে দাবি করেন নি। শুনেছি তখন এমএন লারমা, চারু বিকাশ চাকমাসহ একটি প্রতিনিধি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে এ দাবি করেছিলো। সাথে মং প্রু সাইনও ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা কেমন ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশীর ভাগ লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো, অনেকে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলো, একটার পর একটা এলাকায় পাকিস্তানীরা হানা দিচ্ছিলো। তখন ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ে কোন কোন সম্প্রদায় থেকে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- ত্রিপুরা, মারমা থেকে বেশীরভাগ লোক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তবে চাকমা থেকে নগন্য সংখ্যক লোকও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময়কালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে বলুন।

বকুল চন্দ্র চাকমা- ১৯৭১ সালে যখন পাক হানাদার বাহিনী যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয় তখন রাঙামাটির ডিসি এইচটি ইমাম সাহেব রাঙামাটির সকল সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে এক জরুরী সভা করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় ডিসি মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রয়োজনে সবাই ভারতে আশ্রয় নিবেন, এছাড়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত হয় সভায়। সেসময় পাক হানাদার বাহিনী যাতে রাঙামাটিতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন স্থানে বেরিকেড দেয় ছাত্র ও জনতা। যাতে পাকিস্তানী হেলিকপ্টার বা যুদ্ধ বিমান নামতে না পারে সেজন্য তৎকালীন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাঠে গাছ-পালা দিয়ে বেরিকেড দেওয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ পাহাড়ী ছাত্র ও যুবককে সংগঠিত করে বিভিন্ন স্কুল থেকে ডামি রাইফেল ও লাঠি নিয়ে রাঙামাটি শাহ হাই স্কুল মাঠে “ট্রাইবাল মুক্তি ফৌজ” গঠন করা হয়। এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এমএন লারমাকে। তখন এমএন লারমা অবিবাহিত ছিলেন। পরে শুনেছি ডিসি সাহেব ট্রাইবাল মুক্তি ফৌজের লিডারদের না জানিয়ে ভারতে চলে গেছেন। ফলে ট্রাইবাল মুক্তি ফৌজ ভেঙ্গে যায়। তারপরেও অনেকে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা ও মারমাদের অংশগ্রহণ বেশী থাকলেও চাকমাদের অংশগ্রহণ সেক্ষেত্রে অনেকটা কম ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- পাকিস্তানী বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের কতটুকু পর্যন্ত এসেছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- তখনতো উপজেলা ছিলো না। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো উপজেলা আছে, প্রায় সব উপজেলাতেই পাকিস্তানী বাহিনী সেসময় প্রবেশ করেছিলো। পানছড়িতেও তারা অবস্থান করেছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- তখন তাদের অত্যাচারের মাত্রা কেমন ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তাদের অত্যাচারের ধরণ ছিলো ভিন্ন রকম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৌতুক করতে করতে অত্যাচার করতো তারা। ধরুন, বৃদ্ধ দুই লোক আসতেছিলো রাস্তা দিয়ে কলা নিয়ে, তাদের থামিয়ে কুস্তি খেলাতে বাধ্য করা হয়েছিলো। একজনকে দিয়ে আরেকজনকে মারা হতো, এই রকম বিভিন্ন পর্যায়ের অত্যাচার ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- অন্যান্য জেলার চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে কি অত্যাচার কম হয়েছিলো? কেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- সম্ভবত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অত্যাচারের মাত্রা কম ছিলো। এখানে মিজো বাহিনীও ছিলো। মিজোরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো। মিজোরা না থাকলে পাকিস্তানীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে পারতো না। গেরিলা যুদ্ধের শুরুতে মিজোদের হাতেই মহালছড়িতে ক্যাপ্টেন কাদের মারা গিয়েছিলো। পাকিস্তানীরা যেখানে থাকতো মিজোরাও সেখানে অবস্থান করতো।

সাউথইস্ট জার্নাল- মিজোরা অস্ত্র কোথায় পেলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- পাকিস্তানীরা মিজোদেরকে অস্ত্র দিয়েছিলো। এছাড়া ভারতের সাথে বিরোধীতার কারণে তাদের কাছে আগে থেকেই অস্ত্র ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- ৭১ এর আগেও কি পার্বত্য চট্টগ্রামে মিজো বাহিনী ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- হ্যাঁ, যুদ্ধের আগেও বিভিন্ন সময়ে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলো। বিশেষ করে যখন ভারত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতো তখন তারা এখানে চলে আসতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা আসার পর তারা পাহাড়ে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- মিজোরা যখন রাঙ্গামাটি গেছে তখন ত্রিদিব রায়ের সাথে কি তাদের দেখা হয়েছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- মিজোরাও পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো, ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো, স্বভাবতই সম্পর্ক ছিলো তাদের মধ্যে।

সাউথইস্ট জার্নাল- মিজোরা কতদিন ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামে?

বকুল চন্দ্র চাকমা- মিজোরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানীদের সাথে চলে গেছে।

সাউথইস্ট জার্নাল- স্বাধীনতার পর পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের বঙ্গবন্ধুর কাছে যে বিভিন্ন দাবি করেছিলেন। এসব দাবি নিয়ে সাধারণ পাহাড়ীদের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশ্র একটা প্রতিক্রিয়া ছিলো। এসব দাবি নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণাও ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- ৭৩ এ রাঙ্গামাটির জনসভায় ভাষন দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কতবার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- পার্বত্য চট্টগ্রামে কতবার এসেছেন সেটা আমার জানা নেই। ৭৩ এ রাঙ্গামাটির জনসভায় ভাষন দেওয়ার পরে আরো ২বার এসেছিলেন। তবে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন অনেকবার। বঙ্গবন্ধু রাঙামাটি আসার আগে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে পাহাড়ীদের মাঝে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। যুব সংঘ নামের ঐ কমিটির নেতৃত্বের ছিলো পঙ্কজ কুমার দেওয়ান ও নির্মল চাকমা। পরে এটি উপজাতি যুব সংঘ নামে আত্নপ্রকাশ করে। সম্ভবত এই উপজাতি যুব সংঘ পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সাথে কন্টেষ্টে ছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ী ছাত্র সমিতি কত সালে এবং কার নেতৃত্বে সৃষ্টি হয়?

বকুল চন্দ্র চাকমা- পাকিস্তান আমলেই পাহাড়ী ছাত্র সমিতি সৃষ্টি হয়। স্নেহময় চাকমা ছিলেন এই কমিটির সভাপতি, রুপায়ন দেওয়ান ছিলেন সেক্রেটারি। পরবর্তীতে এই পাহাড়ী ছাত্র সমিতিই জনসংহতি সমিতির ছাত্র সংগঠন হয়। যখন বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটির ভাষনে “আমরা সবাই বাঙ্গালী” ঘোষনা করেছিলেন তখন উপজাতি যুব সংঘের লোকজন কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলো। কারণ, চাকমা রাজা এই বাঙ্গালী শব্দটাকে পাহাড়ীদের অন্যভাবে ভূল বুঝিয়েছিলেন। যার কারণে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে থাকলেও যুব সমিতির মাঝে কিছুটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। পরবর্তীতে সুমিত রায়কে নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিলো। তবে ঐ নির্বাচনে এম এন লারমা জয়লাভ করেছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- সুমিত রায়কে বঙ্গবন্ধু মনোনয়ন দেওয়ার পর যুব সমিতির প্রতিক্রিয়া কি ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- সুমিত রায়কে মনোনয়ন দিলেও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষনের ভুল ব্যাখ্যা দেবার কারণে কিন্তু একটা প্রভাব পড়েছিলো নির্বাচনে। ফলে এমএন লারমা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলো।

সাউথইস্ট জার্নাল- পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন কয়টি নির্বাচনী আসন ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- ২টা, স্বাধীনতার আগে ১টা,পরে ২টা। উত্তরাঞ্চল আর দক্ষিনাঞ্চল। দুজনই ছিলো জনসংহতি সমিতির প্রার্থী। একজন এমএন লারমা, আরেকজন চিংকিউ রোয়াজার বাবা চাথোয়াই রোয়াজা। দুজনই জিতেছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে কি পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে মনে করেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধু থাকলে সমস্যা এতদূর এগুতো না, তিনি বিশাল উদার হৃদয়ের মানুষ ছিলেন, তিনি পারতেন। নির্বাচিত হবার পরে কওমনওয়েলথ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু এমএন লারমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমএন লারমাতো সেখানে শুধু পাহাড়ীদের কথা বলেননি, পুরো বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন, নির্যাতিতদের কথা বলেছিলেন। সম্ভবত ৭৩-৭৪সালের দিকে।

সাউথইস্ট জার্নাল- কিন্তু এর আগে থেকেইতো সন্তু লারমা শান্তিবাহিনীর প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন।

বকুল চন্দ্র চাকমা- হ্যাঁ। যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তবে এতদূর এগুতো না বিষয়টা, আরো আগেই সমাধান হতো, এই যে শান্তি চুক্তি হলো, সেটাও আরো আগে হতো। শান্তিবাহিনীর সৃষ্টিটা হয়তো লারমা নিজের ডিফেন্সের কথা চিন্তা করেই করেছেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রমতো সন্তু লারমাই শুরু করেছিলেন। এমএন লারমার সাথে এর কোন সংশ্লিষ্টতা ছিলো কি?

বকুল চন্দ্র চাকমা- না, পলিটিক্যাল সাপোর্ট না পেলেতো একটা সশস্ত্র সংগঠন টিকবে না, কাজেই এটার সাথে এমএন লারমা কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- পাহাড়ী ছাত্রদের জন্য ঢাকায় হোস্টেল নির্মানসহ বঙ্গবন্ধুর বহু কল্যাণমুখী পরিকল্পনা ছিলো, এ সম্পর্কে কি জানেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- আমরাতো শুনেছি বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডও উনার কনসেপ্ট ছিলো। ফ্রেমটা দাড় করিয়েছিলেন। কামরুজ্জামান, জিল্লুর রহমানসহ রাঙ্গামাটিতে একটা মিটিং হয়েছিলো রাঙ্গামাটিতে, নাম ছিলো উন্নয়ন সম্মেলন। পাহাড়ের সব নেতাকে নিয়ে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, পাহাড়ী ছাত্রদের জন্য উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াও নানারকম কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন।

সাউথইস্ট জার্নাল- কাপ্তাই বাঁধ যদি পাহাড়ীদের ক্ষতি করে তবে সেটা আমেরিকার সহায়তায় পাকিস্তানীরা করেছিলো। কিন্তু সশস্ত্র আন্দোলনটা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে না হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হলো কেন?

বকুল চন্দ্র চাকমা- তখনতো এমএন লারমা জেলে ছিলো, আর বাকি নেতারা আন্দোলন জোরদার করতে পারে নাই। রাজারাতো কাপ্তাই বাঁধের পক্ষেই ছিলো। রাজারা ছিলো সামন্ততান্ত্রিক, শাসন তান্ত্রিক মনোভাবের। যার কারণে ওভাবে আন্দোলন জোরদার হয়নি, লোকজনও ততটা সচেতন ছিলনা।

সাউথইস্ট জার্নাল- মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে সন্তু লারমার ভূমিকা কি ছিলো?

বকুল চন্দ্র চাকমা- যুদ্ধের সময় সন্তু লারমা যুদ্ধে অংশ নেন নি। বরং দেশ স্বাধীন হবার পর অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলো।

বকুল চন্দ্র চাকমা সত্য উন্মোচনে তার মূল্যায়ন ব্যক্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বশরীরে তার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা না থাকলেও তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন ও আছেন। তিনি তার মূল্যায়নে একপেশে নীতি পরিহার করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকীর এই ক্ষনে বকুল চন্দ্র চাকমার বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই।