জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম - Southeast Asia Journal

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী

“আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন- জানো খোকা, আমাদের দেশে এমন একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল মানুষের প্রতি দুর্বলতা। মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রুপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তা বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম? তাঁর নামও খোকা। তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।” -সাহিত্যিক সাংবাদিক আহমদ ছফা।

বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখতে পারে- এমনটি বিশ্বাস করেনি ব্রিটিশ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের শাসকরা। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো রাজনীতিতেও একজন বংশীবাদকের আবির্ভাব হবে কেউ ভাবেনি। ভাবেনি কেউ,বাংলাদেশে এমন একজন নেতার জন্ম হতে পারে যিনি সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাসে নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, মার্টিন লুথার কিংকেও ছাড়িয়ে যাবেন। তবে সত্যিই একদিন এ জাতির মুক্তির লক্ষ্যে স্রষ্টার প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন একজন। তিনি রাজনীতির কবি, মানবতার কবি, মানবতার গান গেয়ে যার পথ চলা, তিনি বাঙালির একমাত্র অভিভাবক, ইতিহাসের কিংবদন্তি, বিশ্বের বিস্ময় মহান নেতা শেখ মুজিব। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র কেবল নয়, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই হয়তো সেদিন ভাবতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর জাদুমন্ত্রে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের-যার নাম হবে বাংলাদেশ। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা হবে একটি নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে তথা পুরো পূর্ববঙ্গকে সূর্যের আভায় প্রজ্জ্বলিত করে জন্ম হয় শেখ মুজিবুর রহমানের। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে শেখ মুজিব তৃতীয়। বাবা-মা আদর করে তাঁকে “খোকা” বলে ডাকতেন। টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়া গাঁয়ের একজন খোকা থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন জাতীয় নেতা, জাতীয় নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা আর বঙ্গবন্ধু- জাতির পিতা শেখ মুজিব থেকে রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিশ্বনন্দিত নেতায় পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধু একটি সংগ্রামী অধ্যায়, একটি সংগ্রামী ইতিহাস, আর সেই ইতিহাস মানেই বাঙালির ইতিহাস।

সাত বছর বয়সে টুঙ্গীপাড়ায় তাঁর পূর্বপুরুষদের গড়ে তোলা গিমা ডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষা জীবন শুরু করেন। নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হয়ে চার বছর তাঁর পড়ালেখা ব্যাহত হয়। ফলে ১৯৩৬ সাল থেকেই তিনি চোখে চশমা পড়া শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মথুরানাথ ইনিস্টিটিউট মিশন স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে মেট্টিক পরীক্ষা শুরু হবার একদিন পূর্বে ভীষণ অসুস্থ হন। ফলে ডাক্তারেরা তাঁকে ঐ বছর পরীক্ষা দিতে বারণ করা সত্ত্বেও তিনি পরীক্ষা দেন। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে আই.এ.পাস করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর বহু স্মৃতিবিজরিত বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ১৯৪৬ সালে বি.এ. অধ্যয়নের সময় কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস. নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজ হতে বি.এ. পাশ করে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে আইন বিভাগে অধ্যয়ন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সামিল হওয়ার অপরাধে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিঃস্কার করা হয়।

ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকেই শেখ মুজিব ছিলেন অনন্যসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন ও ছাত্রলীগ গঠন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন ও খাদ্যের দাবীতে ঢাকায় ভুখা মিছিলের আয়োজন, ১৯৫১ সালে পাকিস্তান গঠনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতির বিরোধিতা, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের বিরোধিতা ও প্রতিবাদে কারাগারে অনশন, ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার বিজয়, ১৯৫৫ সালে আওয়ামীলীগের অসা¤প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ, ১৯৫৬ সালে স্বায়ত্বশাসনের দাবী ও সাংবিধানিক সংখ্যাসাম্যের বিরোধীতা, ১৯৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলনে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ ঘোষণা, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে কারাবাস, ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, ১৯৬৩ সালে আইয়ুবি সংবিধানের বিরোধিতা ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে পদত্যাগ, ১৯৬৪ সালে আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীবন, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অনিরাপত্তাজনিত অবস্থা পর্যবেক্ষণ, ১৯৬৬ সালের ০৫-০৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদল সমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয়-নির্বাচনি কমিটিতে ঐতিহাসিক ০৬ (ছয়) দফা দাবি পেশ, ১৯৬৭ সালে ১২টি মামলার হুলিয়া, ১৯৬৮ সালের “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার এক নম্বর আসামি, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এ সংবর্ধনা সমাবেশে তাঁকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৫ই ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় তিনি পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন “বাংলাদেশ” এবং ঘোষণা করেন-পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল “পূর্ব পাকিস্তানের” পরিবর্তে আজ থেকে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ” হবে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (ময়মনসিংহের নান্দাইলের নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় এর আসন ব্যতীত) এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

শেখ মুজিবই এদেশে প্রথম রাজনীতিকে সাধারণ মানুষ তথা গ্রামের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর উদ্দীপনাময় ও আবেগময় বক্তৃতা সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে মুগ্ধ ও প্রাণিত করত। নবাব অভিজাত শ্রেণি যাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, তিনিই তাঁদের নেতা হলেন, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রথম কৃষকের অধিকার নিয়ে রাজনীতি করলেও তাঁর মধ্যে একটি দোলাচল কাজ করত। কিন্তু শেখের বেটা হয়ে উঠলেন সত্যিকারের গণমানুষের নেতা। প্রিয় দেশবাসীর বিপরীতে তাঁর ‘ভায়েরা আমার’ ‘বোনেরা আমার’ শব্দবন্ধ গোটা জনগোষ্ঠীকে আন্দোলিত করেছিল। শেখ মুজিবের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সবার সঙ্গে থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া। তিনি যখন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তখন, সেই পদটি দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আবার তিনি যখন সভাপতির পদ অলংকৃত করেন, তখন সেই পদটিই দলের ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়।

বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও ঐন্দ্রজালিক আহবানে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই দারিদ্রমুক্ত, অসা¤প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- “Leadership is the capacity to translate vision into realit”(নেতৃত্ব হলো স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলার সক্ষমতা)। বঙ্গবন্ধু ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তিনি বাঙালির মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইতিহাসের পরিক্রমায় বাঙালির জীবনে আসে এক মাহেন্দ্রেক্ষণ – ৭ই মার্চ। অবহেলা ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় আসন্ন অবস্থা। ৭ মার্চ বিকেল তিনটায় ভাষণ দেবেন বাঙালির প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভোরের আলো ফোটে উঠার সাথে সাথেই পাল্টে যেতে লাগে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের চারপাশ। সকালের পর থেকেই জনস্রোত বয়ে যায় পুরো ঢাকায়, বিশেষত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ৭ই মার্চের অমূল্য ভাষণ থেকে দেশ ও জনগণের অপরিসীম ভালবাসার ভাবটা কয়েকটি বাক্যের মধ্যে সুস্পষ্ট। তিনি রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সব আগাম নির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করলেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।

বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় এ ভাষণটি বাঙ্গালি জাতির ঐতিহাসিক দলিল। আব্রাহাম লিংকন এর “গেটিসবার্গ এডড্রেস”, স্বামী বিবেকানন্দের “শিকাগো ভাষণ” এবং মার্টিন লুথার কিং এর “আই হ্যাভ ড্রিম” ভাষণের মত বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিও যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা ও সাহস যোগাবে।

কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে লিখেন, “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?” সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনটা বিশ মিনিটে মঞ্চে আসেন বক্তৃতার শ্রেষ্ঠ কবি। ভাষণ চলতে থাকা সময়ে বারবার গর্জে ওঠে উত্তাল ওই জনসমুদ্র। প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০ টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিটের ১১০৫ শব্দের এই কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ডকুমেন্টারী হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটি ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) অর্ন্তভুক্ত করে। এ ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় উজ্জীবিত রাখবে। বিদেশী প্রভাবশালী পত্রিকা নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে ‘Poet of Politics’ বলে আখ্যা দেয়।

রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে ত্যাগই ছিল বঙ্গবন্ধুর পথ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ‘ত্যাগের মাধ্যমে আদর্শের জয় হয়’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৮)। ত্যাগের মহিমা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর কথা, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১১৮)। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে’ (ঐ পৃ. ১৬৪)। তাই তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেজন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৭৩)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত ডায়েরী অবলম্বনে প্রকাশিত “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” ও “কারাগারের রোজনামচা” বই দু’টি শুধুমাত্র আত্মজৈবনিক বই নয়, হয়ে উঠেছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এ উপমহাদেশের বিশেষত পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনবদ্য, নিরপেক্ষ, নির্মোহ দলিল; একজন হৃদয়বান নেতার এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করে সেসব সমাধানের সংগ্রামের অসাধারণ আখ্যাণ; টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক দুরন্ত কিশোরের সারা বাংলার মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার এক অন্তরঙ্গ গল্প। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির প্রথমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নোট বইয়ের একটি উদ্ধৃতি রয়েছে। উদ্বৃতিটি আমাদের সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো, কারণ মাত্র তিনটি বাক্যে ওই উদ্বৃতি দিয়ে তিনি তাঁর আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ পরিষ্কার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্বিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন তাঁর সেলের পাশে কবর খনন করা হয়, তখন তাঁর মনের অবস্থা কিরুপ হয়েছিল বা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা মনে হয়েছিল কিনা, ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের এক প্রশ্নের বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, ‘আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয় স্বজনের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশের জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা (সাধারণ মানুষ) কী গভীরভাবে ভালোবাসে।” রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১৯৬৮ সালের মধ্য জানুয়ারীতে যখন পাকিস্তানি সেনা প্রহরায় বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়, তখন তাঁর মনে গহিনে সৃষ্ট অনুভুতি তিনি পরে এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, তোমাকে আমি ভালবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৫৬)। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় নুরু নামে সুকন্ঠী এক কয়েদির গান শুনে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘গান গাও নুরু, বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে সেই গান গাও’ (ঐ, পৃ. ১৩০)। এর মধ্যে প্রকাশ পায় বাংলা ও বাঙালির প্রতি কী গভীর অনুরাগই না ছিল বঙ্গবন্ধুর!

সব অর্থেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল এক ধ্বংসস্তুপ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। সঞ্চয় জিডিপির ৩ শতাংশ। বিনিয়োগ ৯ শতাংশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার মাইনাস ১৪ শতাংশ। রাস্তাঘাট, বন্দর, রেললাইন ও সেতু বিধ্বস্ত। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন। লাখ লাখ ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি। প্রকৃতি প্রতিকূল। আন্তর্জাতিক পরিবেশও (বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া) অনুকূল নয়। এমনি এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে দেশ চালানোর দায়িত্ব নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্ত স্বদেশে পা রেখেই ঘোষণা করেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়েই তিনি ‘শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলায়’ রূপান্তর করবেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ‘সুস্থ-সবল-জ্ঞান-চেতনা সমৃদ্ধ-ভেদবৈষম্যহীন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের উন্নত এক বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তাঁরই উদ্ভাবিত স্বদেশজাত উন্নয়ন দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে, যে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যে বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি হবে চিরস্থায়ী, যে বাংলাদেশ হবে চিরতরে ক্ষুধামুক্ত-শোষণমুক্ত, যে বাংলাদেশে মানব-মুক্তি নিশ্চিত হবে, যে বাংলাদেশে নিশ্চিত হবে মানুষের সুযোগের সমতা, যে বাংলাদেশ হবে বঞ্চনামুক্ত-শোষণমুক্ত-বৈষম্যমুক্ত-সমতাভিত্তিক-অসাম্প্রদায়িক দেশ। বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত-শোষিত-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের মুক্তির কথা ভাবতেন – যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে ও চিন্তায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করেননি, সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অর্থনৈতিক দর্শন। রক্তে ভেজা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশের সংবিধানেই স্থান দিয়েছেন দারিদ্র্য মুক্তির পথ নির্দেশনা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন নির্ভীক। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দারিদ্র্য নির্মূলের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার, শিল্প বিকাশে নয়া উদ্যোগ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, কৃষির আধুনিকায়নে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ, সমবায় চেতনা বিকাশে শুরু করেছিলেন কর্মযজ্ঞ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়া, মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা, নারী জাগরণ কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে সবসময় বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিল সাধারণ জনগণ। পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে গ্রহণ করেন নানা পদক্ষেপ- যার অন্যতম ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা। পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য তাঁর ‘অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’-র অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রথম সফরকালে পশ্চাৎপদ পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের একটি পৃথক বোর্ড গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তৎকালীন ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাঙ্গামাটির সার্কিট হাউসে ৯ আগস্ট ১৯৭৩ সনে এক সুধী সমাবেশে জাতির পিতার পক্ষে এ এলাকার জন্য একটি পৃথক বোর্ড গঠণের ঘোষণা দেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তাপ্রসূত একটি প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী প্রজ্ঞায় যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছিল তাঁর সে উদ্দেশ্যেকে বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে।

মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে আমাদের কেমন অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্বমানের মানবসম্পদ কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব তার সবই রয়েছে জাতির পিতার অর্থনৈতিক দর্শনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দারিদ্র্য মুক্তির লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা শুধু বাংলাদেশেই প্রাসঙ্গিক তা নয়, পিছিয়ে পড়া অন্য জাতি ও রাষ্ট্রের জন্যেও পথ নির্দেশিকা। আত্মনির্ভর জাতীয় বাজেট প্রণয়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্পণ্য করেননি বঙ্গবন্ধু। পুনর্বাসনের পাশাপাশি নতুন অবকাঠামো তৈরিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছাপ পড়ে সরকারি নানা কর্মসূচিতে। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ছিল এ দেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল ঐতিহাসিক বিশ্বাস- জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম হলো “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট অন্ধকারের পেট চিঁড়ে যখন বেরিয়ে আসে সোনালি ভোর, কিচিরমিচির শব্দ করে রাত জাগা পাখিগুলো ঘোষণা করছে রাতের শেষ প্রহর, মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসছে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি, তখন ধান্ডমন্ডির ৩২ নম্বরে ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম-কলঙ্কজনক অধ্যায়। মীর জাফরের রক্তের কণিকা বহনকারী কিছু উচ্চাভিলাষী বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সহায়তায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে সময়ের নির্ভীক পুরুষ, জাতির দৃপ্তকন্ঠের প্রতিনিধি, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলার স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পবিত্র জুমার দিনে ফজরের নামাজের সময় মীর জাফরের দল হত্যা করল একজন শ্রেষ্ঠ মানবকে, একজন উদারচিত্তের মানবতাবাদী মহৎ মানুষকে, সর্বোপরি একজন ধর্মপ্রান মুসলমানকে। অসুরের হাতে বলি হলো একজন পবিত্র মানুষ। পবিত্র রক্তে আবারও ভিজে গেল বাংলার বুক। বাঙালি জাতি হারাল তাদের জাতির পিতাকে, বিশ্ব হারাল এক মহান নেতাকে। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ সড়ক দিয়ে প্রবাহিত রক্তস্রোতে বাংলায় যেন সৃষ্টি হয় নতুন এক লোহিত সাগর। বাঙালির জীবনে রচিত হয় গ্রিক ট্র্যাজেডি-র আরেক উপাখ্যান।

এই নৃশংস হত্যাকান্ড ও বিভীষিকার ভয়াবহতা বোঝাবার ভাষা নেই। পৃথিবীর সকল ভাষার সকল শব্দ উজাড় করে দিয়েও এই বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা যাবে না। শুধু এইটুকু বলা চলে, ছয়-শ বছর পর বাংলার সবুজ প্রান্তরে কবর থেকে যেন উঠে এসেছিল তৈমুরের প্রেতাত্মা কিংবা তেরো-শ’ বছরের আগের এজিদের বংশধররা। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট অসুরের দল শুধু জাতির পিতাকেই নয়, ধান্ডমন্ডির ৩২ নম্বরে আরও হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, জীবনের সুখ-দুঃখের সাথি বেগম ফজিলাতুন্নেছা-যাঁর অপার অনুপ্রেরণা ও সীমাহীন ত্যাগ ছিল বঙ্গবন্ধুর অপরিমেয় শক্তি, একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল এবং সর্ব কনিষ্ঠ প্রাণাধিক শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে’। ব্রিটিশ এম.পি. জেমস লামন্ড লিখলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে’।

বঙ্গবন্ধু নিজেই এক ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। ইতিহাসের এই কিংবদন্তিকে হত্যা করে যারা বদলে দিতে চেয়েছিল ইতিহাসের ধারা, তারা জানে না হত্যা করেই থামানো যায় না ইতিহাসের পথ চলা। সময়ে হাত ধরে আঁধার পেরিয়ে ইতিহাস এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। ইতিহাসের হাত ধরেই সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু কবর থেকে উঠে এসেছেন তাঁর প্রিয় সোনার বাংলায়, তাঁর প্রিয় মানুষের কাছে। ইতিহাসের রক্তগোলাপ হয়ে ফুলে-ফলে, ফসলের মাঠে, কৃষকের হাসি, রাখালের বাঁশি, মাঝির ভাটিয়ালি গানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত মিছিল, কবিতার আসরে, নাটকের মঞ্চ-সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব। কে রুখে তাঁর দুর্বার গতি, কার আছে এমন সাধ্য? যতদিন বাংলার মাটি, মানুষ, বৃক্ষ, আকাশ, প্রকৃতি থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে, অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে।

বেঈমান আর বর্বর কাপুরুষরা ভুলে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু একটি চেতনা, একটি অমর আদর্শ, একটি মানচিত্র, বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। এই চেতনার কখনো মৃত্যু হতে পারে না, তাই এই মানচিত্রও বিলীন হওয়ার নয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানেরও কখনো মৃত্যু হওয়ার নয়। তিনি চেতনা ও অনুপ্রেরণার অপার উৎস হয়ে সদা চিরঞ্জীব কোটি কোটি বাঙ্গালির হৃদয়ে। খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় সবার প্রাণের কথা লিখলেন অনবদ্য চয়নে, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

এস. এ. করিম তাঁর Sheikh Mujib: Trump and Traged গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে ‘A Tragic Hero’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাঙালির ইতিহাসে সত্যিই তিনি ‘ট্র্যাজিক হিরো’। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর অমর র্কীতি। রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব আর মানুষের ভালবাসার মাঝে বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, চির অম্লান।

মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা যেমন ছিল দিগন্তবিস্তৃত, তেমনি এদেশের মানুষও তাঁকে গভীর ভালবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছিল আস্থায়-বিশ্বাসে। দেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম এক সোনার দেশ-এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সেই পথে আজকে দুর্বার গতিতে অগ্রসরমান বাংলাদেশ। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার লক্ষ্য পূরণে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল, প্রাজ্ঞ, সুদক্ষ, সময়োপযোগী, জনকল্যাণকর ও অর্ন্তভূক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্জনে দৃঢ় প্রত্যয়ে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়, এক অনুকরণীয় ‘রোল মডেল’। বাংলাদেশকে ২০২১ সালে “মধ্যম আয়ের দেশ”, ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত করতে আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী। তাই, বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা বির্নিমানে আমাদের সবাইকে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সবোর্চ্চ আত্মনিয়োগ করতে হবে যার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পারব গড়ে তুলতে পারবো অসা¤প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সম্মৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

 

Table of Contents

লেখক- উপসচিব, সদস্য-পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড
তথ্যসূত্রঃ
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রকাশকাল: ২০১২। প্রকাশনী : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
২. কারাগারের রোজনামচা, প্রকাশকালঃ মার্চ, ২০১৭। প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমী।
৩. অশ্রুসিক্ত বাঙ্গালী, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম, ২০১৭।
৪. Bangladesh a Legacy of Blood: Anthony Mascarenhas
৫. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম: গাজীউল হক
৬. স্মৃতি অম্লান ১৯৭১: আবুল মাল আব্দুল মুহিত, (সাহিত্য প্রকাশ)
৭. Witness to Surrender: Siddiq Salik
৮. A Tale of Millions: Bangladesh Liberation War- 1971: Maj. Rafiqul Islam
৯. মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু: নুরুল ইসলাম মঞ্জুর
১০. ইতিহাসের রক্ত পলাশ: আবদুল গাফফার চৌধুরী
১১. টাইম সাময়িকী USA মুজিব।। স্থপতির মৃত্যু ২৫ আগষ্ট ১৯৭৫ http://content.time.com/time/subscriber/article/0,33009,913420-2,00.html.
১২.বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ- ড. আতিউর রহমান, সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ, ২০১৯
১৩. Rashid, Harunor| “Mujib, (Bangabandhu)SheikhMujibur”| Banglapedia| Asiatic Society of Bangladesh, ২০০৬।