করোনা মহামারির ক্রান্তিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলো সাধারণ মানুষের পাশে আছে কি? - Southeast Asia Journal

করোনা মহামারির ক্রান্তিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপজাতি দলগুলো সাধারণ মানুষের পাশে আছে কি?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান) যথাক্রমে চারটি আঞ্চলিক উপজাতি সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনহংহতি সমিতি (জেএসএস), পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) দলগুলোর জনসম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সন্তু লারমার একনায়কতান্ত্রিক ও জনবিরোধী কার্যক্রমের বিরোধীতা করে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার আদর্শকে ধারণ করে সংস্কারপন্থি নেতাদের সমন্বয়ে জেএসএস ভেঙ্গে গঠিত জেএসএস (এমএন লারমা) ও সাম্প্রতিক সময়ে প্রসীত বিকাশ খীসার আদর্শ বিবর্জিত কর্মকান্ড প্রত্যাখ্যান করে গঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্বত্য চট্টগ্রামে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী জনগনের অধিকার রক্ষায় ও পাহাড়ীদের অধিকার সংরক্ষনের প্রশ্নে পার্বত্য চুক্তির বাস্তায়ন ও পাহাড়ে যেকোন ক্রান্তিকালে পাহাড়ীদের পাশে থেকে বিপদে-আপদে এগিয়ে এসে জনসম্পৃক্ত ও জনকল্যানমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিভিত্তিক সকল সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢালাও ভাবে চাঁদাবাজির অভিযোগ আসলেও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ও প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ জনকল্যাণে একেবারেই সম্পৃক্ত হচ্ছে না। কিন্তু অন্য দুটি সংগঠন জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আসলেও সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা পাহাড়ীদের পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করছে। তবে তাদের চাঁদাবাজির বিষয়টি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে ভীতি ও অনিশ্চয়তা। তাছাড়া করোনা (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে লকডাউন, বর্তমানে মানুষের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশেও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রামেও করোনা মোকাবেলায় সরকারী ছুটির পাশাপাশি এক প্রকার অঘোষিত লকডাউন চলছে। এরই মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় পৌঁছে গেছে সরকারী ত্রাণ। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকল্পে চলছে সরকারী-বেসরকারী প্রচারণা। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পাহাড়ের আঞ্চলিক ২টি উপজাতি সংগঠন ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এমএন লারমা)’র পক্ষ হতেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, জীবানুনাশক স্প্রে, প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ছবি-১: খাগড়াছড়িতে জেএসএস (এমএন লারমা)’র জীবানুনাশক স্প্রে কার্যক্রম।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের বেশ কয়েকটি উপজেলায় জীবানুনাশক স্প্রে করছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (এমএন লারমা)। গত ৩০শে মার্চ থেকেই তিন পার্বত্য জেলা সদরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)র উদ্যোগে জীবাণুনাশক ঔষধের পানি ছিটানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২রা এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদরের পৌর এলাকা জীবানুনাশক ঔষধের পানি ছিটানো হয়।

এর আগে গত ১লা এপ্রিল থেকেই জনসাধারণকে সচেতন করতে মাঠে নেমেছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র নেতাকর্মীরা। ১লা এপ্রিল সকালে জেলার ভাইবোনছড়া, পানছড়ি উপজেলার দেওয়ানপাড়া, মুনিগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে জীবানুনাশক স্প্রে করেছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র নেতাকর্মীরা। সংগঠনটির নিজস্ব অর্থায়নে ও পানছড়ি উপজেলা শাখার নেতা দিপন আলো চাকমার নেতৃত্বে এদিন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে, বাড়ি-ঘর, যানবাহন স্প্রে ও প্রচার-প্রচারণা চালায় সংগঠনটির নেতারা।

ছবি-২: মাটিরাঙ্গায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র ত্রান বিতরণ।

একইদিন বিকেলে জেলার মাটিরাঙ্গায় সংগঠনটির মাটিরাঙ্গা উপজেলা সভাপতি সুলেন চাকমার নেতৃত্বে উপজেলার ওয়াসুপাড়া, চক্ক্যা মুড়া পাড়া, হরিদন বগপাড়া, বরজালা পাড়া, পূর্ব খেদারচড়া পাড়া এলাকায় অর্ধশত পাহাড়ী-বাঙ্গালি গরীব, অসহায় ও করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, আলু, তেল, লবন ও পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

ছবি-৩: বাঘাইছড়িতে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র ত্রাণ বিতরণ।

এছাড়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার জীবঙ্গা ছড়া (বাবু পা), চৌমূহনি, কলেজ রোড, মধ্যম পাড়া, মাষ্টার পাড়া, হাসপাতাল এলাকা, জীবতলি, তালুকদার পাড়া, মুসলিম ব্লক, উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন লোক সমাগম স্থানে ও বিভিন্ন সড়কে গত ৪ঠা এপ্রিল শনিবার সংগঠনটির নেতা জুপিটার চাকমার নেতৃত্বে দিনব্যাপী জীবানুনাশক স্প্রে করেছে জেএসএস (এমএন লারমা)’র নেতাকর্মীরা।

গত ৫ এপ্রিল রবিবার সকালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি, ফাতেমা নগর, পোড়াবাড়ি, কলাবাগান, দমদম, শান্তি নগর এবং টিএন্ডটি এলাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র উপজেলা সমন্বয়ক দীপন আলো চাকমার নেতৃত্বে দুঃস্থ ও করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়াদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। একই দিন জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বেশ কয়েকটি এলাকায় লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা সমন্বয়ক জ্যোতিষ চাকমার নেতৃত্বে ২শতাধিক অসহায়, দুঃস্থ ও কর্মহীন পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছে সংগঠনটির নেতারা।

ছবি-৪: বাঘাইছড়িতে জেএসএস (এমএন লারমা)’র জীবানুনাশক স্প্রে।

এরপর গত ৬ এপ্রিল সোমবার সকালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র রাঙামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলা সমন্বয়ক জনপ্রিয় চাকমার নেতৃত্বে বাঘাইছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় দুঃস্থ ও করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়াদের মাঝে সংগঠনের পক্ষ হতে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এছাড়া একই দিন দুপুরে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউপি কার্যালয়ে শতাধিক পাহাড়ী ও বাঙ্গালী নারী পুরুষের মাঝে চাল, ডাল, তৈল সহ নিত্যপণ্য সামগ্রী বিতরন করে সংগঠনটির নেতারা।

এদিকে ১৭ এপ্রিল থেকে সংগঠনটির নিজস্ব অর্থায়নে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গায় সংগঠনটির মাটিরাঙ্গা উপজেলা সভাপতি সুলেন চাকমার নেতৃত্বে উপজেলার ১নং তাইন্দং ইউনিয়নের বগাপাড়া, শ্বর্বস্বর পাড়া, মনিদাশ পাড়া, আচালংমগ পাড়ায় শতাধিক পাহাড়ী-বাঙ্গালি গরীব, অসহায় ও করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, আলু, তেল, লবন ও পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সংগঠন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ও প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ প্রতিবছর প্রায় আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে তা দিয়ে তারা মুলত সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা, লবিং, অস্ত্র সংগ্রহ এবং নেতাদের পকেট ভারী করলেও যাদের কাছ থেকে সারাবছর পাহােড়ীদের উন্নয়নের কথা বলে, আদর্শিক স্বপ্ন দেখিয়ে চাঁদা আদায় করছে, আজ তাদেরই ক্রান্তিকালে সন্তু লারমা ও প্রসীত বিকাশ খীসা নিরব। অন্যদিকে নতুন গঠিত জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যেই পাহাড়ী-বাঙ্গালী ভেদাভেদ না রেখে সকলের কথা চিন্তা করে জনকল্যানমূলক কাজ করছে, বাকিদের তুলনায় এদের জনসম্পৃক্ততাও অনেক বেশী বলে জানান তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রাম প্রধান (কার্বারী) জানান, অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এ দুঃসময়ে জেএসএস (সন্তু) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) সাধারণ পাহাড়ী জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। সাজেকে হামে আক্রান্ত বাচ্চা ও পরিবারগুলোর পাশে সবার আগে থাকার কথা এ দুটি আঞ্চলিক দলের। অথচ আমরা দেখলাম পাশে এসে দাঁড়িয়েছি বিজিবি আর সেনাবাহিনী, জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। তারা বলেন, এসবের অর্থ একদম পরিষ্কার, পাহাড়ে অস্ত্রধরে, চরকি ঘুরিয়ে, জুজুর ভয় দেখিয়ে জোর করে চাঁদা আদায় করে নেতাদের পকেট ভারী করা, পাহাড়ে বসবাসকারীদের চুষে নিংড়ে খাওয়ার জন্যই কেবল জন্মিয়েছে সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসার আঞ্চলিক দল।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এক সাবেক গেরিলা নেতা জানান, নেতৃত্বের কিছুটা গুণাগুন ছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমার। যার ছিটাফোঁটাও নেই সন্তু লারমার মধ্যে। রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করে এ সন্তু লারমা। রাষ্ট্রীয় টাকায় চলাফেরাসহ নিরাপত্তা, জাতীয় পতাকা বহণকারী গাড়ি, আলিশান বাড়ি-সবকিছুই ভোগ করছেন তিনি। অথচ পাহাড়ী জনগনের বিপদে তাকে কখনো এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কর্মহীন হয়ে পড়া পাহাড়ের অসহায় ও দুঃস্থদের মাঝে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত থাকবে জানিয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’র কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা তরু বলেছেন, তাদের লক্ষ্য, যেসব এলাকায় সরকারী বা বেসরকারী কোন ত্রাণ এখনো পৌঁছায়নি, সেসব এলাকা থেকে দুঃস্থদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছেন তারা। পাশাপাশি করোনা সংকট উত্তোরণ না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে জীবানুনাশক স্প্রে, প্রচার পত্র বিলি, মাস্ক বিতরণ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণসহ বাড়ি বাড়ি ত্রাণ বিতরণ করবে সংগঠনটি। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে পাহাড়ের অবহেলিত ও কর্মহীনদের মাঝে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতিও অনুরোধ জানান আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনের এই নেতা।

অন্যদিকে জেএসএস (এমএন লারমা)’র কেন্দ্রীয় নেতা ও বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা জানিয়েছেন, ‘দুর্গম অনেক এলাকায় মানুষের ঘরে খাবার নেই, এমতাবস্থায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা ভাগ্যের ব্যাপার। দেশের এই ক্রান্তিকালে পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের পাশে এগিয়ে এসে জেএসএস (এমএন লারমা) সরকারের পাশাপাশি পাহাড়ে নিজেদের উদ্যোগে অসহায়দের মাঝে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে জনগনের কষ্ট লাঘবে সর্বদা নিয়োজিত থাকবে বলেও জানান এই জনপ্রতিনিধি।