মুক্তিযুদ্ধে বান্দরবানঃ এক ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ - Southeast Asia Journal

মুক্তিযুদ্ধে বান্দরবানঃ এক ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

 

প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা:

পরিচিতিঃ-
আমি ১৯৫৪ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারী রাংগামাটি সদর উপজেলার চেঙ্গিমুখ এলাকায় জন্ম গ্রহণ করি। আমার পিতা- জনাব সত্য বিলাস ত্রিপুরা, মাতা- বন দেবী ত্রিপুরা। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর চেঙ্গিমুখ পাানির নীচে তলিয়ে যাওয়ার পর আমরা গর্জনতলীতে চলে যাই। আমার পিতামহের চাকুরীর সুবাদে ১৯৬২ সালে আমি তাঁর সাথে বান্দরবান চলে যাই এবং বান্দরবান সরকারী উচ্চ বিদ্যলয়ে সরাসরি ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৭০ সালে তথা হতে মাধ্যমিক পাশ করার পর রাংগামাটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হই।

সূচনাঃ
০৭ই মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমি রাংগামাটি থেকে বান্দরবান চলে যাই। ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহের দিকে বান্দরবানে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য হলো পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত সৈনিকদেরকে খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবুর রহমান, মোখলেছুর রহমান, মংস মিয়ান্ট (জনি বাবু), শফিকুর রহমান, ছাত্র নেতা আব্দুল ওয়াহাব, ক্যশৈপ্রু (খোকা), উচপ্রু, উচনু, আমি এবং আরো অনেকে এই সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলাম। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু এলাকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাহিনীর সৈনিকেরা প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর প্রচন্ড অক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে (তদকালীন মেজর) কর্ণেল অলি আহম্মদ (তদকালীন ক্যাপ্টেন), ক্যাপ্টেন নাসের এবং অন্যান্য বাংগালী সৈনিকরা বান্দরবান হয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার যন্ত্রপাতি নিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। এই দলের অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেৃন হারুন গুরুতরভাবে আহত হওয়ায় তাঁকে অর্ধমৃত অবস্থায় মিয়ানমারে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তবে যুদ্ধকালীণ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকায় তিনি আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনননি।

ভারতে প্রশিক্ষণঃ

মুক্তিবাহিনী সৈনিকদের পশ্চাদপসরণের পর সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম ভেংগে পড়ে। আমি এবং আরো অনেকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পুনরায় বান্দরবানে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্দুল ওয়াহাব, ভুবন মোহন ভট্টাচার্য, সত্য রঞ্জন মল্লিক, চিত্ত রঞ্জন মল্লিক, সুকুমার দাশ, হরি সাধন শুক্ল দাশ, সত্যেন্দ্র মজুমদার, সুকুমার দাশ এবং আমি রুমা হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ভারতের দেমাগ্রী মহকুমায় পৌঁছি। দেমাগ্রীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য তখনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়নি। আমরা শরণার্থী হিসাবে তথায় অবস্থান করতে থাকি। মে মাসের শেষ দিকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলার পর আমরা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। দেমাগ্রী মিজোরামের একটি মহকুমা শহর। এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ১নং সেক্টরের অধীন ৪নং সাব-সেক্টর হিসাবে অন্তর্ভূক্ত। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য জুলাই মাসের ০৯/১০ তারিখের দিকে আমরা বাংলাদেশের রুমায় উপস্থিত হই। আমরা মোট ৮০ জন এফ এফ ছিলাম। ৪০ জনের একটি দল গালেঙ্গা পাহাড় অতিক্রম করে লোহাগড়া উপজেলার পদুয়ার দিকে অগ্রসর হয়। অন্য ৪০ জনের দলটি (আমরা বান্দরবানের মুক্তিযোদ্ধারা ও অন্যরা) বান্দরবানের দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বান্দরবান শহরটি ছিল চারিদিকে পাহাড় বেষ্টিত। রণ কৌশলগত দিক বিচেনায় এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপনের জন্য এলাকাটি ছিল অত্যন্ত উপযুক্ত। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বান্দরবানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প থাকলে এখানে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা সম্ভব হবে এবং একইসাথে ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এখান থেকে পার্শ্ববর্তী পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, চকরিয়া ইত্যাদি সমতল এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করা সহজ হবে। তাই প্রথমেই আমরা বান্দরবান দখলের সিদ্ধান্ত নিই।

অপারেশন ক্যচিংঘাটা, বান্দরবান:
আমরা দলে মোট ৪০ জন এফ এফ ছিলাম। বিশাল দুটি নৌকায় ৪০ জনের এই এফ এফ দলটি জুলাই মাসের ১৩ তারিখের দিকে সন্ধ্যায় বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রুমা ত্যাগ করে। ১৪ তারিখ ভোর চারটার দিকে নৌকা দুটি বান্দরবানের ক্যচিংঘাটা এলাকায় সাংগু নদীর পাড়ে অবস্থিত একটি খামার বাড়ী অতিক্রম করছিল। খামার বাড়ীটি ছিল শত্রুপক্ষের এমবুশ পয়েন্ট। ঠিক তখনই আমরা শত্রুপক্ষের আক্রমণের মুখোমুখি হই। খামার বাড়ীতে ওঁৎ পেতে থাকা শান্তি কমিটির সদস্যরা আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের দুজন সহযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করে এবং আরো একজনের হাঁটুতে গুলি লাগে। অক্রমণের সময় বেশীরভাগ মুক্তিযোদ্ধা নৌকায় ঘুমিয়ে ছিল। ফলে আচমকা আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ে। আমরা নৌকা থেকে লাফিয়ে নদী সাঁতরে অপর পাড়ে বালির ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিই। আব্দুল ওয়াহাব ভাই নৌকায় শুয়ে রাইফেল দিয়ে পাল্টা গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। মৃত দু’জনের মধ্যে একজন সঞ্জীবন চাকমা। আরেকজনের নাম মনে নেই।

অন্যান্য অপারেশন ও প্রাসংগিক তথ্য:
বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমান বান্দরবানের কিছু যুবক, দলছুট কিছু ইবিআর, ইপিআর এবং পুলিশ সদস্য নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেছিলেন। যুবকদের মধ্যে কবির আহমদ, মংশৈহ্লা, কামাল, জামাল এবং আরো কয়েকজন ছিলেন। আর ইবিআর এর ছিলেন হাবিলদার নুরুল কবির, হাবিলদার মোজাফ্ফর, নার্সিং সিপাই রকিব উদ্দিন, মোস্তাফিজ, নায়েক আশরাফ, ইপিআর এর ছিলেন ওয়ারল্যাস অপারেটর আব্দুর রহমান, আতাউর ওস্তাদ, পুলিশের ছিলেন হাবিলদার সুবাস বড়ুয়া, ওয়ারল্যাস অপারেটর ওজিদ ছেত্রি, আনসারের নিয়ামত ওস্তাদ এবং আরো অনেকে। এই দলটির অবস্থান ছিল চন্দনাইশ থানার ধোপাছড়ি রিজার্ভ ফরেষ্ট এলাকায়। এই দলেরও উদ্দেশ্য ছিল বান্দরবান শত্রুমুক্ত করে তথা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের। আমাদের আসার বিষয়টি তারা জানত। আমাদের সাথে মিলে একসাথে বান্দরবান আক্রমণের পরিকল্পনা তাদের ছিল। কিন্তু ক্যচিংঘাটায় আমাদের বিপর্যয়ের পর তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আমি প্রায় একমাস এই দলের আশ্রয়ে থেকে তাদের সাথে কয়েকটি অপারেশনে যোগ দিই। দলটি ধোপাছড়ি হতে বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি সফল অপরেশন পরিচালনা করেছিল। এর মধ্যে লোহাগড়ার রাজঘাটা মাদ্রাসা অপারেশন এবং সাতকানিয়া কলেজ অপারেশন উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে দলে গোলাবারুদ কমে যাওয়ায় দলের অনেক সদস্য ভারতে চলে যায়। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি পুনরায় ভারতের দেমাগ্রী প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রত্যাবর্তন করি এবং পুনরায় প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করি। সম্ভবতঃ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে অশোক মিত্র কারবারী এর নেতৃত্বে ১১২ জনের একটি এফ এফ কোম্পানিতে আমি অন্তর্ভূক্ত হই। আমরা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি হয়ে রাতের আঁধারে বালাঘাটা কুহলং বটতলী হয়ে ধোপাছড়ি বাজারের সন্নিকটে সাংগু নদীর তীরে রাত্রি যাপন করি। কিন্তু ইত্যবসরে পাক বাহিনী ধোপাছড়ি বাজার দখলে নিয়ে নেয়। ফলে আমাদের কোম্পানী রাতের আাঁধারে ধোপাছড়ি রিজার্ভ ফরেষ্ট অতিক্রম করে রাংগুনিয়ার পদুয়া হয়ে সড়কভাটার কাছাকাছি একটি খামার এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি। এখান থেকে আমরা বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করি এবং ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ রাংগুনিয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হই। কেবলমাত্র কোদালা চা বাগান ছিল পাক বাহিনীর দখলে। পাকবাহিনী আমাদের দখলে থাকা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে অতর্কিতে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল (২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) দক্ষিণ কোদালা চা বাগান হয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি গ্রামে বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। আসলে এটি ছিল আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য তাদের একটি অপ-কৌশল। আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান ছিল গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। আমাদের কোম্পানির একটি দল নিয়মিতভাবে প্রতিদিন নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো টহল দিত। সেদিনও একটি দল প্রতিদিনের মতো টহলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। একজন গ্রামবাসী দৌড়ে এসে খবর দিল তাদের গ্রাম পাকবাহিনী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সাথে সাথে আমরা তিন কিলো মিটার পথ অতি দ্রুত অতিক্রম করে প্রতি আক্রমণ শুরু করি। পাক বাহিনী আমাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করে। আমরা ২ ইঞ্চি মর্টার থেকে তাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করলে তারা ভরকে যায় এবং পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। পাক বাহিনীর সে আক্রমণে তিনজন গ্রামবাসী পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে আলম এর নেতৃত্বে ভারত থেকে আসা একটি বি এল এফ কোম্পানী শিলক এলাকায় অবস্থান নেয়। পাক বাহিনীর দোসর ছিলেন বান্দরবান বোমাং সার্কেলের প্রয়াত রাজা অংশৈ প্রু চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী (মৃত), আব্দুর রশিদ মাষ্টার (মৃত) এবং বান্দরবান জামে মসজিদের পেশ ইমাম। এরা তৎকালীন কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং তাঁর ছেলে রতনকে বান্দরবানের রেইচা এলাকায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তারা বান্দরবানের হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলা ও পুরুষদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের পক্ষে বান্দরবান শহরকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা,
গর্জনতলী, রাংগামাটি।