মনিপুরে চলমান সংঘাত, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী বিষয়ক চিন্তাভাবনা - Southeast Asia Journal

মনিপুরে চলমান সংঘাত, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী বিষয়ক চিন্তাভাবনা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পালিত হচ্ছে আদিবাসী দিবস। এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা, সভা সমাবেশ, বাক-বিতন্ডা হবে, আবার তা আদিবাসী দিবস পার হয়ে যাওয়ার পর থিতিয়েও যাবে। বাংলাদেশে কারা আদিবাসী, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো আদিবাসী কিনা? ইতিহাস কী বলে? আদিবাসীর সংজ্ঞা কী? এসব নিয়ে আজ আলোচনা করব না, আর এগুলি নিয়ে দেশে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝেছি, আদিবাসীর সংজ্ঞা পশ্চিমা ভাব-ধারণার সাথে অনেকটাই সম্পৃক্ত। যেমন- আমেরিকাতে রেড ইন্ডিয়ান, কানাডাতে ফাস্ট নেশান, অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাবোরোজিন, নিউজিল্যান্ডে মাউরি ইত্যাদি।

বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দটা দেখতে সাদা মনে হলেও এর পিছনে রাজনীতি, বিভক্তি, স্বার্থপরতা জড়িয়ে আছে, সেখানেই আপত্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি ও কৌশলগত সম্প্রদায় জনমত বানিয়ে ও গল্প তৈরি করে (Political Elite, Strategic Community by manufacturing consent and narratives) বিষয়টি নিয়ে বিষ বৃক্ষের সৃষ্টি করেছেন। অনেকদিন থেকে আদিবাসী সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৬৯ (ILO Convention 169) স্বাক্ষর করার জন্য বাংলাদেশের উপর বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চল থেকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পশ্চিমাদের ইন্ধন আছে। মোটা দাগে ILO Convention 169 বিধান অনুযায়ী আদিবাসী এলাকাতে তাদের আইন-কানুন, শাসন চলবে। তাদের এলাকাতে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন তাদের অনুমতি ছাড়া করা যাবে না। সেখানে সরকারেরও কোনো ভূমি অধিকার থাকবে না। পরিশেষে, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে মনে হলে জাতিসংঘ সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী প্রেরণ করতে পারবে, যা আসলে বাংলাদেশের সংবিধান ও অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের (core value) সাথে সাংঘর্ষিক।

তবে বিষয়টিকে আজ আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করব। পার্বত্য অঞ্চলে কুকিদের ঐতিহাসিকভাবে প্রথম আগমনকারী ও বসতি স্থাপনকারীদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই কুকিদের অবস্থান উত্তর-পূর্ব ভারতের মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, আসাম, মিজোরাম, মিয়ানমারের চিন, সাগাইং, কাচিন রাজ্যে। আর বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান উল্লেখযোগ্য। কুকিদের সিংহভাগ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হওয়ার পেছনের ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ। যখন ব্রিটিশরা বুঝতে পারল, উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ ধরে রাখা যাবে না, তখন তারা ‘ক্রাউন কলোনি’ (Crown Colony) স্থাপনের দ্বারা উত্তর-পূর্ব ভারত ও তৎসংলগ্ন বার্মাতে মিশনারিদের মাধ্যমে পাহাড়ি অঞ্চলে পিছিয়ে থাকা উপজাতিদের ভিতর খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তার, প্রচার, প্রসারের মাধ্যমে তাদের পদচিহ্ন রাখার কৌশল অবলম্বন করে। তবে সেই পরিকল্পনা মাফিক ‘ক্রাউন কলোনি’ স্থাপন সম্ভব না হলেও মিশনারিদের মিশন অনেকাংশে সফল হয়েছে। আজ ভারত ও মিয়ানমারের এ এলাকার রাজ্যগুলিতে উল্লেখযোগ্য খ্রিস্টান সংখ্যাগুরু। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের জাতিগুলির মাঝে ক্ষুদ্র অনেক জাতি (বম, লুসাই, পাংখু, খিয়াং) যারা বৃহৎ কুকি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তারা প্রায় অনেকাংশে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে।

আমি এখানে ভারতের মনিরপুরের ‘কেস স্ট্যাডি’ তুলে ধরছি। গত তিন মাস ধরে মনিপুর জ্বলছে, প্রাদেশিক সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এমনকি সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সহিংসতায় শত শত প্রাণ গেছে, হাজার হাজার মানুষ আভ্যন্তরীণ শরণার্থী হয়েছে। বিষয়টি জাতিগত দাঙ্গাতে রূপ নিয়েছে। মনিপুরের অধিবাসীদের ৪০% কুকি, যাদের প্রায় সবাই খ্রিস্টান এবং ৬০% মেইতি, যারা হিন্দু। হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে এই সহিংসতা শুরু হয়। যেখানে বলা হয়, মেইতি জনগোষ্ঠী কুকিদের মতো তফসিলি উপজাতি (Schedule Tribe) এর সকল কোটা বা অন্যান্য সুবিধা পাবে। অর্থাৎ মেইতিরা কুকিদের সুবিধাতে ভাগ বসাবে। এই চলমান দাঙ্গাতে আশেপাশের রাজ্য থেকে এমনকি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কুকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি এই দাঙ্গাতে মনিপুরী কুকিদের সাথে মিলে সশস্ত্র সংঘাতে যোগ দিয়েছে। সহসা এর সমাধান দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্ব জানিয়েছে, তারা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, ভারত চাইলে আমেরিকা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দান করবে।

বাংলাদেশ ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র বা রিজিওনাল পাওয়ার না। আজ যদি বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের ভাষা অন্যরকম হবে। এখন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করা যাক। এখানে বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব আছে, ধর্মীয় বিভেদ আছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যক্রম আছে। ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি আমরা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র কার্যকলাপ দেখেছি, যাদের প্রায় শতভাগ খ্রিস্টান। কেএনএফের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কুকি প্রধান এলাকা নিয়ে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র কায়েম করা। সম্ভবত সে কারণেই আমরা বাংলাদেশের কুকি সন্ত্রাসী সংগঠনকে মনিপুরী কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে হাত মেলাতে দেখতে পাচ্ছি।

বাংলাদেশ যদি ILO Convention 169 স্বাক্ষর করে আর বাংলাদেশে যদি মনিপুরের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের ভাষা বা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলির (International Nongovernment Organization) কার্যক্রম বা ভাষা ভিন্ন হবে। তাদের আচরণ ও চাপ প্রয়োগের পদ্ধতিও ভিন্ন হবে। সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ দেখতে পাব, কারণ ও ILO Convention 169 তার অনুমোদন করে।

তাহলে মনিপুর ঘটনা থেকে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষনীয় বিষয়গুলি কী?
ক। দেশের অভ্যন্তরে আদিবাসী ইস্যু নিয়ে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তৎপরতা আছে তা নিয়ে বাংলাদেশের সরকার ও চিন্তাশীল গোষ্ঠিগুলির (Think Tank) সাবধান থাকা।
খ। ILO Convention 169 স্বাক্ষরের জন্য বিভিন্নভাবে বংলাদেশে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তবে এই কনভেনশনে আমাদের স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকা।
গ । পার্বত্য জেলাগুলোতে জাতিগত বা ধর্মীয় বিদ্বেষ বা বিভেদ যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে সরকারের প্রশাসন, সকল সংস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা।
ঘ। কোনভাবে যেন পাহাড়ে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠির অধিকার, অনুভূতি (Sentiment), মান-সম্মান ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা বা যারা বিভেদ সৃষ্টিকারী তাদেরকে নজরদারিতে রাখা।
ঙ । বাংলাদেশের নীতি, প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলকে প্রশ্রয় না দেয়া। একইভাবে প্রতিবেশী দেশগুলি যেন এই নীতি মেনে চলে, রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে সেই নীতি, আদর্শ মেনে চলার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা/কাজ করা।

মনে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী ইস্যু নিয়ে যারা সোচ্চার, তারাও এদেশের নাগরিক/জনগণ। গণতন্ত্রে সকলের মুক্ত চিন্তা করার অধিকার আছে। সভ্য সমাজে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খোলা রাখতে হবে। এমনকি কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের বিপক্ষে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা/কার্যক্রম (Corrective Measures) নিতে হবে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা/কার্যক্রম (Punitive Measures) না। সেখানেই রাষ্ট্র ও গোষ্ঠি বা দলের পার্থক্য। কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র কতটা সভ্য সেটি নির্ভর করে সেই সমাজে সংখ্যালঘিষ্ঠরা কতটা স্বাচ্ছন্দে আছে তার উপর।

লেখক: লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, পিএইচডি, প্রাক্তন প্রিন্সিপাল ষ্টাফ অফিসার, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।