রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের বোঝা: প্রয়োজন দ্রুত প্রত্যাবাসন

তাপস হালদার
২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশের ছয় বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমার থেকে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যা, শিশু ও নারীদের নির্যাতন, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে এমন নিধনযজ্ঞ শুরু করা হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সেদিন রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন মানবতার মা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ছোট বোন শেখ রেহানা।’ দিনটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম একটি কালো দিন। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন মানবিকতার দিকটিই বড় করে দেখেছিলেন। কারণ এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়া সরকারের পক্ষে মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। তবুও তিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য দ্রুত খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন।
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯ দফা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, মিয়ানমার প্রতিদিন তিনশ জন করে প্রতি সপ্তাহে ১৫শ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে এবং দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করবে। এই চুক্তি দলিলের ৩ নং অনুচ্ছেদে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের ওপর বিশেষ জোর, ১৪ নং অনুচ্ছেদে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা এবং ১৮ নং অনুচ্ছেদে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যের সমস্যার সমাধান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। চুক্তি দলিলটি বাস্তবায়িত হলে এটি হতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে অনন্য দলিল। কিন্তু মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৮ সালে প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মিয়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু মিয়ানমারকে চুক্তির পর দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করতেও পারেনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর নীরবতাও আমাদের কাছে অত্যন্ত দুঃখজনক।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কেউ ভাবতে পারেনি, সমস্যাটা এতটা জটিল হবে। দ্রুত যখন নভেম্বরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পাদন হয় তখন সবাই মনে করেছিল এ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বিগত ছয় বছরে মিয়ানমারের বাস্তবিক কোনো প্রয়োগ দেখা যায়নি।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট নতুন নয়। দেশটি ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পরই নতুন সরকার রোহিঙ্গাদের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করার ১৪ বছর পর ১৯৬২ সালে প্রথম সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। তারপর মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও সেটি কখনো প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেনি। কারণ গণতন্ত্র থাকলেও সামরিক বাহিনীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার আসন সংরক্ষিত ছিল।
যার কারণে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কখনো রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিপূর্ণ অধিকার পায়নি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিজয়লাভ করলেও সাংবিধানিকভাবে সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ থাকার কারণে ক্ষমতা এককভাবে সু চির হাতে ছিল না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করত। প্রকৃত অর্থে ১৯৬২ সালের পরে মিয়ানমারে কখনো গণতন্ত্র পূর্ণতা লাভ করেনি। প্রথম সামরিক সরকার আসার পরই থেকে রোহিঙ্গারা কখনো স্বস্তিতে ছিল না। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনকালে ১৩৫টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও বাদ দেওয়া হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। তখনও রোহিঙ্গাদের ভিনদেশি বাঙালি হিসেবে বলা হয়। অথচ রোহিঙ্গারা স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই মায়ানমারে বসবাস করে আসছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালের পার্লামেন্টে তাদের দুজন মন্ত্রী ও ছয়জন সংসদ সদস্য ছিল।
মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে একটি মামলা করে। শুনানির সময় সে সময়কার সরকার প্রধান অং সান সু চিসহ তাদের সব আইনজীবী ‘রোহিঙ্গা’ নাম ব্যবহার ও তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারপর ২০২১ সালে মিয়ানমারে সরকার পরিবর্তন হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের মতের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে এখনও মামলাটি চলমান রয়েছে।
কক্সবাজার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব মানবিক সেবা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে সব সুযোগ-সুবিধাসহ এক লাখ রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের ভাষা শেখার ব্যবস্থা, জীবিকার জন্য দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে করে তারা দেশে ফিরে যাওয়ার পর দ্রুত সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি বছর নতুন করে জন্ম নেওয়া ৩০ হাজার জনগোষ্ঠী যোগ হচ্ছে। এদের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি, নিরাপত্তা, পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারের মতো অপরাধগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা মানুষের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের এত দীর্ঘ চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা প্রথমে উথিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তাননিমারন খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া ও কেরনতলী পাহাড়ি বনে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয় প্রায় আট হাজার একর জমি। ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় ১১ ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যার কারণে এলাকাটিকে মারাত্মক রকমের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। যতই দিন যাচ্ছে ঝুঁকি বেড়েই চলছে। যদি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও দেরি হয়, তা হলে হয়তো ক্ষতি মোকাবিলা করা একসময় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তিনি এই প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো-১. রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান। ২. আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়াকে সমর্থন করাসহ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করা। ৩. জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। ৪. আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্য মেনে চলার অঙ্গীকার পূরণে মিয়ানমারকে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানানো। ৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ এবং মিয়ানমার যাতে বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকার রাজি হয় সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া।
প্রধানমন্ত্রীর দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন সহজ হবে। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজন এদের দ্রুত প্রত্যাবাসন। এ জন্য বাংলাদেশের পাশে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই একমাত্র এই সংকট সমাধান সম্ভব হবে।
সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ