পাহাড়বাসীর দোষটা কোথায়? - Southeast Asia Journal

পাহাড়বাসীর দোষটা কোথায়?

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মন্তব্য প্রতিবেদন

নারী মর্যাদাহানির শাস্তি বদলি। ভূমিহীনকে ঘর দেওয়ার মহান কাজে দুর্নীতির শাস্তিও বদলি। সরকারি চাকরিজীবীদের শাস্তির এ টোটকা ব্যবহার হচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকে। এখনো অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দৃষ্টির বাইরে নিতে এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই শাস্তির মাধ্যমে ওই এলাকার মানুষদের যোগ্য ও ভালো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়। অপরাধ করেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী। কিন্তু তার দায় নিতে হয় দুর্গম এলাকার আমজনতাকে। ধুরন্ধর কর্মকর্তাদের দুষ্কর্মের বোঝা বইতে হয় সাধারণ মানুষকে।

গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ভাটরা কাছারিবাড়ি জামে মসজিদে জুমার খুতবা শেষ হওয়ার পর ইমামের পেছনে বসে ছিলেন লালমাই উপজেলার ইউএনও ফোরকান এলাহি অনুপম। পরিচয় না জানায় একামত দেওয়ার আগে ইউএনওকে সরে যেতে বলেন ইমাম ও মুয়াজ্জিন। তাতে ইউএনও তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। নামাজ শেষে ইমামকে ডেকে নিয়ে পানিতে চুবানোর কথা বলেন ইউএনও।

এরপর ইমাম-মুয়াজ্জিনকে চাকরিচ্যুত করেন ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ। বুঝতে কারও বাকি থাকে না ইউপি চেয়ারম্যান কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। চেয়ারম্যানকে নানা প্রকল্প ও বাড়তি সুযোগ-সুবিধার জন্য দিন শেষে হাত পাততে হয় ইউএনওর কাছে। এ ঘটনার দুই দিন পর সানে সাহাবা কেন্দ্রীয় কমিটি ও কুমিল্লা জেলা ইমাম সমিতির উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসক বিষয়টির সমাধান করেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে চাকরিতে বহাল করেন। ঘটনার ১০ দিন পর ইউএনও ফোরকানকে বদলি করা হয় রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায়।

শুধু ফোরকান নয়– এ ধরনের বদলির ঘটনা হরহামেশাই ঘটে।

সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোনো অপকর্ম যখন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় তখন প্রথম চেষ্টাতেই তাদের বদলি করা হয়। বদলি কোনো শাস্তি না হলেও এর মাধ্যমে সরকার একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। আর সেটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, আপাতত বদলি করা হলো।

কিন্তু এ বদলির মাধ্যমে অবিচারের সংস্কৃতিই ফুটে ওঠে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে সাধারণত তাকে বদলি করা হয় রাঙ্গামাটি, বান্দরবান বা খাগড়াছড়ির মতো দুর্গম এলাকায়। একইভাবে ভোলার চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর মানুষকে সুজনের সুশাসন থেকে বঞ্চিত করা হয়। যোগ্য কর্মকর্তা গেলে সে তার সেরাটা দিয়েই স্থানীয়দের সেবা দেয়। আর যদি যায় তষ্কর বা বদমেজাজি সে তার স্বভাবমতোই স্থানীয়দের শাসন করার চেষ্টা করেন।

‘চাঁদার’ টাকায় আনন্দভ্রমণে যাওয়ার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. নোমান মিয়াকে খাগড়াছড়ির রামঘর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। আরএমও নোমান মিয়ার নেতৃত্বে ১৭ চিকিৎসক এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ৪০ জন কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে তিন দিনের আনন্দভ্রমণে যান। আরএমও ওই আনন্দভ্রমণের জন্য অন্তত ১০টি ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তিন লাখের বেশি টাকার চাঁদা আদায় করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচও) হাসিনা আখতার বেগম ওই ১৭ চিকিৎসককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।

এভাবে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাই নয়, সেনাবাহিনী ব্যতীত পুলিশসহ অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে দুর্গম এলাকায় পাঠানো হয়। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীই এর ব্যতিক্রম। সেনাসদস্যদের রুটিন বদলির অংশ হিসেবে পাহাড়ে কর্তব্যে পাঠানো হয়। ক্যাডারের বাইরে নন-ক্যাডারদেরও এসব জায়গায় বদলি করা হয়। এসব ‘দুষ্টুরা’ দুর্গম এলাকায় গিয়েও তাদের দুষ্টুমি অব্যাহত রাখে। প্রান্তিক এলাকার প্রায় সব সেক্টরেই যখন তারা জড়ো হয় তখন সেখানকার মানুষ ভালো সেবার আশা করতে পারে না।

একসময় টেলিভিশনে একটি চা-পাতার বিজ্ঞাপন প্রচার হতো। যেখানে প্রভাবশালী ভূমিকায় থাকা এক ব্যক্তি একজন সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকির স্বরে বলেন, তার কাজ না হলে ‘ওভার নাইট বান্দরবানে পাঠিয়ে দেব।’ বিজ্ঞাপনটির প্রচার বন্ধ করার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। এর মাধ্যমে বোঝা যায় নীতিবান কর্মকর্তাদেরও কখনো কখনো প্রভাবশালীরা তাদের মন মতো কাজ না করায় দুর্গম এলাকায় যেতে বাধ্য করতেন।

দুর্গম এলাকায় বদলির বিষয়টি সব সময়ই আলোচিত ছিল। নানা সময়ে দেখা গেছে সরকারি কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেই শাস্তিস্বরূপ পার্বত্য এলাকায় বদলি করা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই ওই অঞ্চলগুলো ‘শাস্তিমূলক কর্মস্থল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই সময় মৃত্যুদণ্ডের বদলে দীপান্তরে পাঠানো হতো। আন্দামান দ্বীপ এমনই একটি জায়গা ছিল। রাজনীতিকদের মতো একসময় আমলাদেরও সেসব জায়গায় পাঠানো হতো।

দূরের কারণে বেশির ভাগ কর্মকর্তা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির মতো জায়গায় চাকরি করতে আগ্রহী হন না। সরকার বদলিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও বদলির আদেশকে শাস্তি হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই। আপিল বিভাগ অগ্রণী ব্যাংকের এক মামলার পর্যবেক্ষণে এমন মতামত দিয়েছে।

তবে সম্প্রতি পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। অনেক কর্মকর্তা ইচ্ছা করে দুর্গম এলাকায় পোস্টিং নেন। কারণ সেই সব জায়গায় চাকরি করলে অতিরিক্ত ভাতা পাওয়া যায়। তা ছাড়া পরবর্তী পদোন্নতিতেও তাদের কিছুটা সুবিধা দেওয়া হয়।