ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দান পালনের অপেক্ষায় পাহাড়ের লাখো পূণ্যার্থী

ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দান পালনের অপেক্ষায় পাহাড়ের লাখো পূণ্যার্থী

ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দান পালনের অপেক্ষায় পাহাড়ের লাখো পূণ্যার্থী
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় গেরুয়া রঙের বস্ত্রকে বলা হয় চীবর। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে কোমড় তাঁতে বানানো বস্ত্র দান করা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। কঠোর নিয়ম মেনে চীবর তৈরি করার এ কাজটি বেশ কঠিন বলেই এর নামকরণ হয়েছে কঠিন চীবর দান।

তথাগত গৌতম বুদ্ধের সময় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বানিয়ে চীবর তৈরি করে বুদ্ধ ও শিষ্যসংঘকে দান করেন গৌতম বুদ্ধের প্রধান উপাসিকা পূণ্যবতি বিশাখা। তার-ই পরম্পরায় ২ হাজার ৫৬৭ বছর ধরে বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে এই কঠিন চীবর দানোৎসব।

তবে সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি বাঙালি সহিংসতার জেরে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাহীনতা’র অভিযোগ তুলে পার্বত্য তিন জেলায় এবারই প্রথম কঠিন চীবর দান উদযাপন না করার ঘোষণা দিয়েছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘ’।

৬ অক্টোব রাঙামাটি মৈত্রী বিহারে সংবাদ সম্মেলন করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিত ভিক্ষু সংঘের সভাপতি ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের এই ঘোষণা দেন। ফলে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য পালনে অপেক্ষায় থাকা লাখো পূণ্যার্থী পার্বত্যাঞ্চলে কঠিন চীবর দানোৎসব নিয়ে পড়েছেন শংকায়। অবশ্য স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে ভিক্ষুসংঘের সাথে বিষয়টি সমাধানের।

সুখ শান্তি অর্জনের পন্থা

বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭২ সালে রাঙামাটির লংগদুতে কঠিন চীবর দানোৎসবের সূচনা করেন রাজবন বিহারের প্রধান পরিনির্বাপিত বনভান্তে। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পার্বত্যাঞ্চলে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ রীতিতে চীবর দান করছেন পাহাড়ের বৌদ্ধধর্মালম্বীরা। আর ১৯৭৫ সাল থেকে রাঙামাটি রাজবন বিহারকে কেন্দ্র করে উৎসবটি একটানা চলছে। মাঝে কেবল ২০২০ ও ২০২১ সালে মহামারি করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ ছিল।

বৌদ্ধদের বিশ্বাস কঠিন চীবর দানের কারণে সুখ শান্তি অর্জনের পাশপাশি পরবর্তী জন্মে সুখ লাভ করা যায়। মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ত্রি-চীবর নামে চার খণ্ডের বিশেষ পরিধেয় বস্ত্র দান করা হয়। যাতে রয়েছে চীবর, দোয়াজিক, অন্তর্বাস ও কটিবন্ধনী।

বনভান্তের ভিক্ষুসংঘ অবস্থান করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন শতাধিক বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব হয়। আয়োজক ও পুন্যার্থিরাও এই দানোৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই সময় স্থানীয়দের দানের অর্থে প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে ব্যাপক সাজসজ্জা আর আনুষ্ঠানিকতায় পাঁচ থেকে বিশ লাখ বা তারও বেশি টাকা ব্যয় হয়। এই আয়োজনে নানান সাজসজ্জা, চীবরদান, ধর্মসভা, বুদ্ধমুর্তিদান, হাজার প্রদীপদান, কল্পতরুদান, সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান, খাবার আর নতুন পোশাকের পেছনে প্রায় প্রতিদিন-ই ব্যয় হয় লাখ লাখ টাকা।

আষাঢ়ি পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ ভিক্ষুরা একটি নির্দিষ্ট বিহারে অবস্থান করে প্রবারণা পুর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাসের বর্ষাবাস সম্পন্ন করেন। এরপর কঠিন চীবর দানের মাধ্যমে ধর্ম প্রচারে বেরিয়ে পড়েন ভিক্ষুরা। এ সময়টাতে আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্ত্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাসব্যাপী সারা দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পালন করেন কঠিন চীবর দানোৎসব। এবছর ১৭ অক্টোবর শরু হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা।

দেশ-বিদেশের লাখো পূন্যার্থির আগমন

মাসব্যাপি চলা দেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দানোৎসবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উৎসবের জনপদে পরিণত হয়। শতাধিক বৌদ্ধবিহারকে কেন্দ্র করে উৎসব ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পাহাড়ি পল্লিগুলোতে চলে উৎসবের আমেজ। এককভাবে পাহাড়ের সবচেয়ে বড় ধর্মানুষ্ঠান ‘কঠিন চীবর দানোৎসব’ আয়োজন হয় রাঙামাটির রাজবন বিহারে। প্রতিবছর এ অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের লাখো পূন্যার্থির আগমন ঘটে। বিশাল এই আয়োজনে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য উৎসব এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।

রাঙামাটি সদর উপজেলা বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমর চাকমা বলেন, সহিংসতার পরে এই যে সন্দেহ, অবিশ্বাসের কারণেই এবার কঠিন চীবর দানোৎসব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক ভিক্ষুসংঘের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেছেন। ভিক্ষুসংঘের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

রাঙামাটি জেলা বিএনপি সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু বলেন, বিগত সরকারগুলোর সময়ে পাহাড়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিচার না হওয়া আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ভিক্ষুসংঘ, ভক্তবৃন্দ ও প্রশাসনকে অনুরোধ করবো। দ্রুততম সময়ে এই বিষয়গুলি সমাধান করে, আমাদের চীবরদানটা যেন আমার সুন্দরভাবে উদযাপন করতে পারি। সকলে মিলে। এই আহবানটুকু সকলের কাছে রাখছি।

রাঙামাটির পুলিশ ড. এসএম ফরহাদ হোসেন বলেন, কঠিন চীবর দানোৎসবে এবার আরও শক্তিশালী ও আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাঙামাটিতে নিরাপত্তাহীনতার কোন সমস্যা নেই। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের পাশাপাশি র্যাব মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হবে।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন। আমরা ভিক্ষু সংঘের ধর্মীয় গুরুদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করেছি। তারা সময় নিয়েছেন বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।