ফটিকছড়িতে লোকচক্ষুর আঁড়ালে সিসা তৈরির কারখানা, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

ফটিকছড়িতে লোকচক্ষুর আঁড়ালে সিসা তৈরির কারখানা, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

ফটিকছড়িতে লোকচক্ষুর আঁড়ালে সিসা তৈরির কারখানা, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

খাগড়াছড়ির রামগড় সীমান্ত লাগোয়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ঘনবসিতপূর্ণ এলাকার একটি বাগানে গোপন কারখানায় ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। এই কারখানার ব্যাটারি পোড়ানোর কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ। কারখানাটি থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ব্যাটারি পোড়ানো ধোঁয়া মানবদেহসহ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারখানাটির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা প্রশাসনের কোন প্রকার অনুমোদন নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ফটিকছড়ির বাগানবাজার ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে খাগড়াছড়ির রামগড়ের পশ্চিম বলিপাড়া সীমানাঘেষাঁ জনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি বাগানের ভিতরে টিনের ঘেরাবেড়ার আড়ালে স্থাপন করা হয় কারখানাটি। যানবাহনের পুরোনো ব্যাটারি এনে স্তূপ করা হয়। রাতের বেলায় এসব ব্যাটারি পুড়িয়ে বের করা হয় সিসা। পরে ব্যাটারির ভাঙ্গা অংশ অ্যাসিড আশেপাশের এলাকায় ফেলা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সিসা কারখানার চারিপাশে ঘনবসিতপূর্ণ আবাসিক এলাকা। দিনে অ্যাসিড আর রাতে ধোঁয়ার গন্ধ এলাকাবাসীর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসী প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল মিলছে না। কারখানাটির অদূরে বলীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও বলিপাড়া বাজার। কারখানার অ্যাসিডের ঝাঁজ পান বিদ্যালয়টির শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও বাজারের দোকানদার-ক্রেতা সকলেই। স্থানীয়রা আরও বলেন, কারখানার চারিপাশে টিনের ঘেরাবেড়া এবং গেইটে সার্বক্ষণিক তালা দিয়ে রাখা হয়। কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়না। দিনের বেলায় নীরব থাকে কারখানাটি। মধ্য রাতে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ।

আহম্মদ খোকন নামে অপর বাসিন্দা বলেন, রাত ১০ টা হতে ভোররাত পর্যন্ত চলে সিসা তৈরি কাজ। আশে-পাশের এলাকা কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। রাতে ঘুমানোর উপায় থাকে না। এসময় ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ছাই বাতাসের মাধ্যমে দূরদূরান্তেও ছড়িয়ে যায়।

শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা পুরোনো ব্যাটারি ও সিসা তৈরির নানা সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ কয়লার বস্তা ইত্যাদি রয়েছে কারখানার এলাকার ভিতরে। দুইটি চুলায় পোড়ানো হয় ব্যাটারি। পুরনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত) বের করে এগুলো চুলায় কয়লার আগুনে পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়। ব্যাটারির অ্যাসিডও বের করে সংরক্ষণ করা হয়।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানাটিতে দিনের বেলায় পুরনো ব্যাটারি থেকে প্লেট খোলা ও অ্যাসিড সংরক্ষণের কাজ করা হয়। আর রাত ১০টার পর প্লেটসহ আনুষঙ্গিক জিনিস পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়।

আমিনুল নামে এক শ্রমিক জানান, তারা ৪-৫জন শ্রমিক কুড়িগ্রাম থেকে এ কারখানায় কাজ করতে এসেছেন। সিসা তৈরি পর কারখানার মালিক এগুলো নিয়ে যান। সাদেক হোসেন নামে এক ব্যক্তি কারখানাটির মালিক। তিনি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাটের ব্যাটারি ব্যবসায়ী।

ওই শ্রমিক আরও বলেন, জাহাঙ্গীর নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির নিজস্ব জায়গায় কারখানাটি ২-৩ মাস আগে স্থাপন করে কাজ শুরু হয়। জাহাঙ্গীরও ঐ কারখানার যৌথ মালিক।

কারখানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুরনো ব্যাটারি কিনে এনে এখানে সিসা তৈরি করা হয়। কারখানায় সবমিলিয়ে ৭-৮ জন শ্রমিক কাজ করেন। তারা দিনে ব্যাটারি কাটেন আর রাতে গলান। এক টন ব্যাটারির প্লেট পুড়িয়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ কেজি সিসা পাওয়া যায়। উৎপাদিত সিসা দেশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হয়। সরেজমিনে পরিদর্শনকালে ব্যাটারি পোড়ানোয় ঐ এলাকায় মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে। বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ে আশের পাশের গাছপালা, লতাপাতা কালোবর্ণ ধারণ করেছে। ব্যাটারির পানি ও অ্যাসিড আশেপাশে ফেলায় পরিবেশ ভয়ানকভাবে দুষিত হচ্ছে। পুরো এলাকায় অ্যাসিড ও ব্যাটারি পোড়ার উৎকট দুর্গন্ধ পাওয়া যায়।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এবিএম মোজাম্মেল হক বলেন, যেকোনো রাসায়নিকের কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে সৃষ্ট ধোঁয়ায় মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে। তবে ফুসফুস রোগাক্রান্ত হয় দ্রুত। এছাড়া মস্তিষ্কসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গও ক্ষতি হতে পারে। এমনকি ধোঁয়ায় কার্বন-মনোক্সাইডের মাত্রা বেশি হলে ক্যানসারও হতে পারে।

তিনি বলেন, বিষাক্ত ধোঁয়া শুধু ওই এলাকায় ক্ষতি করে না, বাতাসের সাথে মিশে দূরদূরান্তেও ছড়িয়ে পড়ে।

কারখানার মালিক সাদেক হোসেনের বক্তব্যের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতা আফরিন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কারখানাটির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি এটি পার্শ্ববর্তী ফটিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। তাই বিষয়টি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছি।’

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘কারখানাটি আমাদের অজানায় ছিল। দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি।’

সূত্র: ইত্তেফাক।