মা হত্যার বিচার চাওয়াও যেখানে অপরাধ!
![]()
মুক্তমত
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাতাসে এখন আর পাহাড়ি নিসর্গের সুর নেই, আছে স্বজনহারা বুকফাটা কান্না আর ভয়ের নিঃশ্বাস। পাহাড়ের মাটিতে প্রতিদিন রক্ত ঝরে, আর সেই রক্ত মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়, কারণ এখানে বিচার চাওয়া মানে নিজের মৃত্যুদণ্ড নিজেই লেখে দেওয়া।
খাগড়াছড়ির পানছড়ির হাতিমারা গ্রামে তিন বছরের এক শিশুর সামনে তার মা রূপসী চাকমাকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। চোখের সামনে মায়ের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেছে শিশুটি, কিন্তু তার কান্নাও পাহাড়ের বন্দুকধারীদের থামাতে পারেনি।
এই হত্যাকাণ্ড নতুন কিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তপাত আর হত্যাকাণ্ড এখন রুটিন ঘটনা। বান্দরবানে উমেপ্রু মারমা, সাজেকে সাত বছরের শিশু রোমিও ত্রিপুরা কিংবা গত দুই দশকে পাহাড়জুড়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। কারণ পাহাড়ে বিচার চাইতে গেলে আরও বড় বিপদ এসে দরজায় কড়া নাড়ে।
আইনের শাসনের বদলে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভয় আর নীরবতার শাসন। যারা বন্দুক হাতে পাহাড় দখল করে রেখেছে, তারাই এখানে চালায় জীবনের নিয়ন্ত্রণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের উপস্থিতি দিন দিন সীমিত হচ্ছে, আর সেই শূন্যস্থান দখল করে নিচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায় শুধু আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নয়, রাষ্ট্রকেও এর দায় এড়ানো চলবে না। পাহাড়ের প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যায় ভয়ের ত্রাসে, অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার। পানছড়ির রূপসী চাকমার পরিবার থানায় মামলা করতে পর্যন্ত যায়নি, কারণ তারা জানে, বিচার চাইতে গেলেই তালিকায় যুক্ত হবে আরও কয়েকটা লাশের নাম।
যারা বলে পাহাড়ে নাকি সেনাশাসন চলছে, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া উচিত এই ভয়াবহ বাস্তবতা। যদি সত্যিই সেনাশাসন চলতো, তাহলে কি হত্যার পর পরই থানায় মামলা করার সাহসটুকুও থাকত না? পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে, না হলে এই পাহাড় তো পুরোপুরি রক্তের নদীতে পরিণত হতো।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
পাহাড়ের মানুষ আজ জানে, এখানে বিচার চাইতে নেই, প্রতিবাদ করতে নেই, সত্য বলতে নেই। সত্য বলা মানে গুম হওয়া, লাশ হওয়া। রূপসী চাকমার মেয়ে একদিন বড় হবে, জানতে চাইবে—তার মা কী দোষ করেছিল? কেন মায়ের হত্যার বিচার হয়নি? সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? রাষ্ট্র কি মুখ লুকিয়ে থাকবে?
যতদিন পাহাড়ে রাষ্ট্রের শক্ত উপস্থিতি নিশ্চিত করা না হবে, যতদিন অবৈধ অস্ত্রধারীদের নির্মূল না করা হবে, ততদিন পাহাড়ের প্রতিটি পরিবার রূপসী চাকমাদের মতো মৃত্যুভয়ে দিন কাটাবে।
বাংলাদেশের পাহাড় কি এই দেশেরই অংশ নয়? তাহলে পাহাড়ে কেন আইনের শাসন প্রহসন মাত্র? পাহাড়ের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে পাহাড়ে রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চাই।
পাহাড়ের প্রতিটি মায়ের নিরাপত্তা চাই, প্রতিটি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাই। নইলে একদিন এই পাহাড়ের মাটি এতটাই রক্ত মাখা হয়ে যাবে যে, কোনো শক্তিই আর এই আগুন নেভাতে পারবে না।
লেখক: মো: সাইফুল ইসলাম
সাউথইস্ট এশিয়া জার্নাল