নিরাপত্তা ঝুঁকির পরও দুর্গম পাহাড়ের ৫০টি স্কুলে স্টারলিংক স্থাপনে চুক্তি করল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ

নিরাপত্তা ঝুঁকির পরও দুর্গম পাহাড়ের ৫০টি স্কুলে স্টারলিংক স্থাপনে চুক্তি করল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

নিউজ ডেস্ক

আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আপত্তিকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে স্টারলিংক এর কার্যক্রম চালু করল সরকার।

এবিষয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যে স্টারলিংক ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-লার্নিং সেবা সম্প্রসারণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউসে এই চুক্তি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএসসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ এমদাদুর রহমান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা, বিএসসিএলের ডোমেস্টিক সেলস ম্যানেজার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নোমান হোসেন, নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ, নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ চাকমা প্রমুখ।

নিরাপত্তা ঝুঁকির পরও দুর্গম পাহাড়ের ৫০টি স্কুলে স্টারলিংক স্থাপনে চুক্তি করল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ

চুক্তির আওতায় পার্বত্য অঞ্চলের ১০০টি বিদ্যালয়ে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ই-লার্নিং কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতিদুর্গম এলাকাগুলোর স্কুলগুলোতে স্টারলিংক চালু করা করা হবে।

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে—দূরবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ইন্টারনেটের সুবিধা পৌঁছে দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা।

নিরাপত্তা ঝুঁকির পরও দুর্গম পাহাড়ের ৫০টি স্কুলে স্টারলিংক স্থাপনে চুক্তি করল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ

উল্লেখ্য, গতকাল দুপুরে চুক্তি সম্পাদনের পর রাতে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরার বাসভবনে অতিরিক্ত এক জেলা প্রশাসকের পদোন্নতিজনিত বদলির প্রেক্ষিতে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও রহস্যজনকভাবে বিএসসিএলের কর্মকর্তাদের দেখা গেছে। যেখানে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

তবে, পার্বত্য মন্ত্রনালয়ের অতি উৎসাহী এই প্রকল্পকে ঘিরে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায় এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও সাইবার সুরক্ষাসহ সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো সংবেদনশীল ও সীমান্তঘেঁষা এলাকায় এই ধরনের সংযোগ অননুমোদিত যোগাযোগ, তথ্য পাচার বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

স্টারলিংক প্রকল্প: পাহাড়ে সুপ্রদীপের প্রযুক্তি বিপ্লব না গভীর পর্যবেক্ষণের ফাঁদ?

বিটিআরসি পূর্বে স্টারলিংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিল, এই প্রযুক্তি দেশের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বাইরে থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি ব্যবহারকারীর কাছে সেবা পৌঁছে দিতে পারে, যা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে কার্যকর রাখে না। ফলে গোয়েন্দা তৎপরতা, প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক, এমনকি প্রশাসনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

এ বিষয়ে পূর্বে প্রকাশিত বেশকয়েকটি কলামে বিশ্লেষক মোঃ সাইফুল ইসলাম উল্লেখ করেছিলেন—

“পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো ভূ-রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অঞ্চলে যদি বিদেশি নিয়ন্ত্রণাধীন স্যাটেলাইট ইন্টারনেট অবাধে কাজ করে, তবে তা কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়—একটি নতুন যুগের গোয়েন্দা প্রবেশদ্বার খুলে দিতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমারের আরাকান ও বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল—এই ত্রিভুজে গোপন যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি হলে তা প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ ফল বয়ে আনবে।”

সরকারি মহল বলছে, শিক্ষার মানোন্নয়নই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য, তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে আগে একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।

পাহাড়ে স্টারলিংক ই-লার্নিং: প্রযুক্তির মুখোশে নিরাপত্তা ঝুঁকি

তবে, গতকাল খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাথে সম্পাদিত ওই চুক্তির আওতায় যেসব স্কুলে (অন্তত ৫০টি) স্টারলিংক সেবা স্থাপন করা হবে সেখানেল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। যেসব দুর্গম এলাকা আবার ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী এলাকাও।

অনুসন্ধান বলছে, খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম ওই এলাকাগুলো আগে থেকেই ভারতীয় মদদপুষ্ট প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রনাধীন। এসব এলাকায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের ব্যাপক আধিপত্যের পাশাপাশি ভারতের সাথে অবাদ সংযোগ রয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এসব সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকার স্কুলগুলোতে অনিয়িন্ত্রিত উচ্চ গতির স্টার লিংক স্থাপন করা হলে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও তাদের ভারতীয় মদদ দাতারা এর অপব্যবহার করতে পারে। এর মাধ্যমে ইউপিডিএফের মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সীমান্তবর্তী প্রতিপক্ষ দেশগুলোর সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার বাইপাস। স্টারলিংক সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে তথ্য পাঠায়, ফলে স্থানীয় টেলিকম নেটওয়ার্ক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে কোনো গোপন যোগাযোগ, পরিকল্পনা বা কনফারেন্স সহজে সম্পন্ন করা যায়। ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ কিংবা সীমান্তবর্তী জঙ্গি গোষ্ঠী এই সিস্টেমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশী এলাকাগুলোর মধ্যে অবাধে তথ্য আদান-প্রদান, লক্ষ্যবস্তুর মনিটরিং, সরবরাহ ও অর্থায়ন করতে পারে।

স্টারলিংকের কার্যক্রমে ‘অস্বচ্ছতা’, স্পষ্টীকরণ চায় বিটিআরসি

এছাড়া, এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ডিজিটাল নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্যের জন্য ব্যবহারযোগ্য। সীমান্ত এলাকা, সরকারি সংস্থার কার্যক্রম, স্কুল বা ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল তথ্য—এমনকি শিক্ষামূলক ডিভাইসেও—ভুয়া বা অচেনা ডিভাইসের মাধ্যমে হ্যাকিং, ডাটা এক্সট্র্যাকশন বা লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ সম্ভব।

তাছাড়া, গোপন ভিডিও/অডিও ট্র্যাকিং, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রপাগান্ডা ছড়ানো এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতেও এই ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে শিক্ষার উন্নয়ন এবং ডিজিটাল সংযোগের নামে প্রকৃতপক্ষে সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়।

প্রসঙ্গত, স্টারলিংক হলো মার্কিন কোম্পানি স্পেসএক্সের মালিকানাধীন স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, যা সরাসরি পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থানরত হাজারো উপগ্রহ থেকে ব্যবহারকারীর কাছে সিগন্যাল পাঠায়—এবং এই সেবা কোনো জাতীয় টেলিকম অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করে না।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may have missed