রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পানির জন্য হাহাকার

নিউজ ডেস্ক
সুপেয় পানির জন্য ধুকছে রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকার মানুষ। পাহাড়ে বসবাসের কারণে সারাবছর এসব গ্রামবাসীকে স্থানীয় ঝিরি-ঝরনার পানির ওপর নির্ভর হয়ে জীবনধারণ করতে হয়। ঘরের সব কাজসহ পানি পানের জন্য এ ঝিরি-ঝরনার পানি ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত বর্ষার সময় থেকে শীত মৌসুম পর্যন্ত ঝিরি-ঝরনা থেকে পানি সংগ্রহ করা গেলেও মাঘ-ফাল্গুন থেকে পাহাড়ে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। সরকারের উদ্যোগে দুর্গম কিছু কিছু পাহাড়ি গ্রামে রিংওয়েল ও টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও শুকনো মৌসুমে এসব থেকে পানি পাওয়া যায় না। গ্রামবাসী আশপাশের নিচু জায়গায় কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমেও এসব কুয়া শুকিয়ে যায়। তার ওপর নভেম্বরের পর থেকে এবছর এখনো পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টি না হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির জন্য ধুকছে এসব গ্রামের মানুষ।
গ্রীষ্মের এই দাবদাহে আধঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে অনেকে কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করে আবার অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে পাশের গ্রাম কিংবা হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। এ যেন এক কলসির ঘামের দামে এক কলসি পানি সংগ্রহ করছে পাহাড়ি এসব মানুষ।
তবে সরকারি হিসেবে, জেলায় ৬৫ ভাগ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের অর্ধেক সময় বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে জেলার ৭০ ভাগ মানুষ পানির অভাবে পড়ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাঙামাটি ১০ জেলার মধ্যে বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব এলাকার মানুষ বেশিরভাগই পাহাড়ের ওপর বসবাসের কারণে গভীর নলকূপও স্থাপন করা সম্ভব হয় না। কিছুটা নিচু জায়গায় পানির স্তর পাওয়া গেলেও সেখান থেকেও পানি সংগ্রহ করতে কষ্ট হয় এসব মানুষের। তারপরও শুকনো মৌসুমে ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্তরও পাওয়া যায় না। একসময় সারা বছরই এইসব গ্রামের মানুষ পার্শ্ববর্তী ঝিরি-ঝরনার পানির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাই তো শুকনো মৌসুম শুরু হলে এসব গ্রামের মানুষের কাছে এক কলসি পানি যেন সোনার হরিণ। আর সেটা যদি সুপেয় পানি হয় তাহলে তো কথায় থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মূলত সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট নিরসন করা সম্ভব না। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সঠিক মতো পাওয়া যায় না। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপনের মধ্য দিয়েও পুরোপুরি পানি সঙ্কট সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
বাঘাইছড়ির সাজেকের তারুম পাড়ার বাসিন্দা মিতা চাকমা। তার এলাকায় ২৫ পরিবারের বসবাস। গ্রামের নিচু জায়গায় রিংওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, শীতের পর থেকে গ্রামে পানির কষ্ট বেড়ে যায়। পাশের ঝিরি থেকে অন্যান্য সময় পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে সেটাও থাকে না। ছড়া শুকিয়ে সড়কের মত হয়ে যায়। তাই তো ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পাশের গ্রাম থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিদিনের স্নানও হয় না বলে জানান তিনি।
সাজেকের শিয়ালদহ ১৬৯ নম্বর মৌজার হেডম্যান ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার জৈপুথাং ত্রিপুরা জানান, সাজেকের শিয়ালদহ, কংলাক, বেটলিং, লংকরসহ বেশ কয়েকটি মৌজায় খাবার পানির সংকট চলছে। এরমধ্যে পুরাতন জুপুই পাড়ায় ৪০ পরিবার, নিউ থাংনাং পাড়ায় ৫০ পরিবার, তারুম পাড়ায় ২৫ পরিবার, কমলাপুর পাড়ায় ১৯ পরিবার, লুংথিয়ান পাড়ায় ৬২ পরিবার, অরুণ পাড়ায় ৭০ পরিবার, খাইচ্যা পাড়ায় ৩০, শিয়ালদাহ ৬২ পরিবার, হাইস্কুল পাড়ায় ৩৫, খগড়াকিচিং পাড়ায় ২৬, নিউ লংকরে ২২ পরিবার, অলংকরে ১৮ পরিবার, হুাদুকপাড়ায় ১৪ পরিবার এবং আনন্দ পাড়ায় ২৮ পরিবার বসবাস করে। তাদের প্রত্যেকেই তীব্র পানির সঙ্কটে ভুগছেন।
সাজেক ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা জানিয়েছেন, সাজেকে সারা বছরই খাবার পানির সংকট থাকে। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় এবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে পানির জন্য হাহাকার বেশি। এলাকাগুলো দুর্গম ও সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করাও খুব কঠিন। অনেককেই বসতবাড়ি থেকে ৭০-৮০ ফুট পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে কুয়া বা রিংওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমানে সেগুলোও শুকিয়ে গেছে।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদেও পানি সঙ্কটের কারণে সুপেয় পানির সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। হ্রদ থেকে পরিষ্কার পানি নিয়ে ফুটিয়ে পান করার জন্যও বেগ পেতে হচ্ছে। শুকনো মৌসুম হওয়ায় পানির স্তর একেবারে নিম্নস্তরে রয়েছে। এজন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে হ্রদের পানি দেখা মিলছে।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত হ্রদে পানির স্তর রয়েছে ৭৭.৫০ এমএসএল। অর্থাৎ বর্তমানের সময়ের তুলনায় আরও পাঁচ ফুট পানি কম রয়েছে কাপ্তাই হ্রদে। কাপ্তাই হ্রদে সর্বনিম্ন পানির স্তর ৬৮ এমএসএল।
ঝিরি-ঝরনার পানির ওপর নির্ভরশীল মানুষদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে পানি বিশুদ্ধকরণে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশিকার নির্বাহী পরিচালক বিপ্লব চাকমা বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মানুষ মূলত যারা ঝিরি-ঝরনার পানির ওপর নির্ভরশীল শুকনো মৌসুমে তাদের পানির সঙ্কট সবচে বেশি। এসময় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরেও পানি পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, যত সময় যাচ্ছে, তত পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। ঝিরি-ঝরনাগুলো মরে যাচ্ছে। এজন্য পানির উৎসসমূহে পানি ধরে রাখতে পানি ধারণ উপযোগী গাছ যেমন চালতা, জলপাই এসব ধরনের গাছ রোপণ করতে হবে। এছাড়া যেসব ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাচ্ছে, সেসবও সার্ভে করে ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
বরকল উপজেলাধীন সুবলং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তরুণ জ্যোতি চাকমা বলেন, পাহাড়ি গ্রামগুলোতে রিংওয়েল, টিউবওয়েল বসিয়ে বছরের অন্যান্য সময় পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে পানি নেই বললেই চলে। এসময় দূর-দূরান্তে যেসব ঝরনায় পানি পাওয়া যায়, সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে এখানকার মানুষ।
তিনি আরও বলেন, এ সঙ্কট কাটাতে পানির উৎসস্থলে বনায়ন ও বাঁশ লাগাতে হবে। না হলে দীর্ঘমেয়াদের এর সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এছাড়া বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে গ্রামে গ্রামে পানি পৌঁছানোর মাধ্যমেও এর সমাধান করা সম্ভব। তবে ঝিরি-ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনাও কমে আসছে। তার ইউনিয়নের মধ্যে কৈকরকিং মারমা পাড়া, মোনপাড়া, হাজাছড়া, হিলছড়ি এলাকায় পানির কষ্ট সবচেয়ে বেশি।
রাঙ্গামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে পানির ব্যবস্থা করা সমতলের চাইতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষের কাছে খাবার পানি পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়নে ৫২টি পানির উৎস সৃষ্টি করছি।
তিনি আরও বলেন, জেলার দুর্গম সব জায়গায় পানির সমস্যা থাকলেও বরকল ও বাঘাইছড়ির সাজেকে এই মাত্রা তীব্র। যেহেতু পাহাড়ি এলাকায় পানির স্তর পাওয়া খুব কঠিন, তাই পাশের ঝিরি-ঝরনা থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আমরা একটি ডিপিপি প্রস্তুত করছি।