চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়নে সূফী সাধক হজরত খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র:) এর অবদান - Southeast Asia Journal

চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়নে সূফী সাধক হজরত খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র:) এর অবদান

সমাজসেবক হজরত খান বাহাদুর আহছানুল্লাহ (রাহ্)

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

জিয়া হাবীব আহসান

শিক্ষা বিস্তার, নৈতিক চরিত্র গঠন ও মানব সেবায় যুগ যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছে মানবিক চেতনার প্রতিষ্ঠান আহছানিয়া মিশন’। আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা  সূফী সাধক বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজসেবক হজরত খান বাহাদুর আহছানুল্লাহ (রাহ্) অবিভক্ত বাংলার ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর ছিলেন । তাঁকে আমরা কমবেশি সকলেই চিনি এবং তাঁর অবদান সম্পর্কেও কমবেশি অবহিত আছি। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রায় ১৭ বছর চট্টগ্রামে ছিলেন এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে পৌছেন। ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টির সেবা ‘এ- মূলমন্ত্র নিয়ে তিনি ১৫ই মার্চ ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরার নলতায় নিজ গ্রামে আহছানিয়া মিশন মানবসেবার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সারাদেশে, দেশের বাইরে মানুষের সেবা, আত্মিক- আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মিশনের কর্মকাণ্ড এবং শাখা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আধ্যাত্মিক সাধক ও মানব প্রেমিক খান বাহাদুর আহছানুল্লাহ পীর আউলিয়ার আবাদভূমি সোনার চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে  ‘চট্টগ্রাম আহসানিয়া মিশন ‘- প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজ সেবায় তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ১৯৮৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ  (মরণোত্তর), বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমি তাঁকে ‘ফেলো'(১৯৬০) মনোনীত করেন।

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনের রয়েল সোসাইটির সদস্য মনোনীত হন। চাকুরী জীবনে  তিনি সৎ ও প্রশংসনীয় কাজের জন্য খান বাহাদুর খেতাব (১৯১১ সালে) লাভ করেন। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিটি ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাঙালি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান সার্ভিস ( আ.ই.এস) এ- অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ১৯১৭-১৮ সালে কার্যকরী পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। শতাধিক গ্রন্থের তিনি রচয়িতা।শিক্ষা সংস্কার,  বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসামান্য অবদান অবিস্মরণীয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খসড়া বিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উত্থাপনের পর দারুণ বিরোধ সৃষ্টি হয়। গঠিত হয় স্পেশাল কমিটি। হযরত আহসানুল্লাহ( র:) এ কমিটির সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূরীকরণে পরীক্ষার উত্তরপত্রে নামের পরিবর্তে ক্রমিক নাম্বার বা রোল নাম্বার লেখার পদ্ধতি তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। উদার ধর্ম ও সমাজ চিন্তার আলোকে আর্তমানবতার কল্যাণে ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরা জেলার স্বীয় জন্মভূমি নলতা গ্রামে আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পরবর্তীতে হবিগঞ্জে তিনি মিশনের শাখা স্থাপন করেন, বর্তমানে দেশে ও বহির্বিশ্বে মোট শাখা মিশনের সংখ্যা ১৪৪ তন্মধ্যে মহিলা মিশনের সংখ্যা উল্লেখ করার মত। ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিক্ষা প্রশিক্ষন ও শিক্ষা নীতি, ভ্রমন কাহিনী, শিশুতোষ রচনা ইত্যাদি বিষয়ক শতাধিক পুস্তকের রচয়িতা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) ১৯০৫ সালে “পদার্থ বিদ্যা” ও ১৯৩১ সালে ইংরেজীতে “History of the Muslim World” রচনা করে বৃঠেনের Oxford University এর ভূয়সী প্রসংশা অর্জন করেন, সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে ফেলোশীপ প্রদান করে। সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূরীকরণে পাবলিক পরীক্ষা সমূহে পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নামের পরিবর্তে রোল নম্বর লেখার রীতি তিনিই প্রবর্তন করেন । তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। চট্টগ্রামে তাঁর জীবন নিয়ে একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম আহসানিয়া মিশন, চট্টগ্রাম বইটি পড়ে আমি অবাক হয়েছি এ মহান সুফি ব্যাক্তিত্ব আধ্যাত্মিক পুরুষ, নৈতিকতার বাতিঘর খান বাহাদুর আহছানুল্লাহ চট্টগ্রামকে কত ভালবাসতেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড় প্রকৃতি,অলি- বুজুর্গ ও ধর্মপ্রাণ নবী প্রেমিক মানুষদের তিনি অত্যন্ত আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯০৭ সালের ২৪শে এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এভাবেই তাঁর চট্টগ্রামে  আগমনের সূচনা।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের জুন পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ইন্সপেক্টর এর দায়িত্বে ছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবন ধারা’ গ্রন্থে  চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্তিম ভালোবাসা চমৎকারভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তার উদ্যোগে ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া কলেজ। এছাড়াও তিনি বহু স্কুল কলেজ ও হোস্টেল প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথমে স্কুলে মৌলভী পদ সৃষ্টি করেন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে  বেতন বৈষম্য দূর করেন। মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের তিনিই প্রথম কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষা সম্প্রসারণে তিনি ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন আর তাঁরই  সাহায্যে সাব ডিভিশনাল হাইস্কুল গুলোর অবয়বব ও সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পায়।  চট্টগ্রামে বহু নতুন নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সূযোগ কাজে লাগান তিনি।

এরমধ্যে অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (১৯২৭), চিটাগাং ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বর্তমানে সরকারী হাজী মোহাম্মদ মহসিন  কলেজ ১৯২৭, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, (১৯০৬),  দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা চন্দন পুরা চট্টগ্রাম (১৯১৩), গভমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল চট্টগ্রাম (১৯০৯) সহ পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে অসংখ্য স্কুল কলেজ মাদ্রাসা হোস্টেল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। তাঁর বড়ো বুজুর্গি হচ্ছে তাঁর ওফাতের পরও তাঁর প্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশন স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরী,চক্ষু ও ক্যান্সার হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল ইত্যাদি পরিচালনা করে আসছে। আমি নিজেই নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন পরিদর্শন করে আবিভূত হয়েছি। শরীয়ত ও তরিকতের এমন সমন্বয় আর কোথাও  তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। শির্ক এবং বিদআত মুক্ত নয়ন জুড়িয়ে যাওয়া পরিবেশ আমাকে আজো আহ্বান জানায় পৃথিবীর প্রকৃত শান্তি ও সূখের আধ্যাত্মিকতার ঐ ঠিকানায়। ১৮৭৩ সালে জন্ম গ্রহন ও ১৯৬৫ সালে প্রভূ র সান্নিধ্যে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর হায়াত এ জিন্দেগী। এক অসাধারণ কর্মশীল মানুষটি চর্মচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তাঁর গড়ে তোলা হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ও লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুরক্ত ও আদর্শিক মানষ সন্তানরা সাদাকায়ে জারিয়া কর্মকান্ড সমূহ চালু রাখার মাধ্যমে মহান মালিকের অশেষ দয়া ও সন্তুষ্টির কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। যা সূফী সাধক হজরত খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বহি:প্রকাশ মাত্র। চট্টগ্রামে তিনি হায়াতে জিন্দেগীতে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্যবার বার আসেন ও অবস্থান করেন। চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক সাধনার অনুকুল পরিবেশের তিনি সদ্ব্যবহার করেছেন। চট্টগ্রামের সূফী সাধক সৈয়দ আহমদুল হক,শিল্পপতি এ কে খান,প্রফেসর ড. আব্দূল করিম প্রমূখ তাঁর একনিষ্ঠ অনুরক্ত ও ভক্ত ছিলেন।তাঁর সান্নিধ্যে এসে চট্টগ্রামের বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন নিজের জীবনকে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দেন এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সহায় সম্পদ মানব সেবায় ও শিক্ষা বিস্তারে ব্যায় করতে থাকেন। সীতাকুণ্ড মসজ্জিদ্দা গ্রামের সমাজসেবক ও জনপ্রতিনিধি আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম চৌধুরী, কক্সবাজারের আলহাজ্ব ফজলুল করিম চৌধুরী,আলহাজ্ব ডা.কাজীআব্দুল মোনায়েম, আলহাজ্ব এস এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, রেঞ্জার আব্দুল মান্নান, মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, আশেক আহমেদ চৌধুরী, আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম চৌধুরী, শামশুল হুদা চৌধুরী, আব্দূস সোবহান চৌধুরী,আলহাজ্ব বাহাউদ্দীন চৌধুরী, ডা শাহাজাহান চৌধুরী, লুৎফুর রহমান চৌধূরী,মকবুল আহমদ,আলহাজ্ব আব্দুর রাজ্জাক প্রমূক অগণিত বিশিষ্ট ব্যাক্তিগণ তাঁর তরিকতের ছেলছেলায় যুক্ত হয়ে নিজেদেরকে এবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত করেন।  এছাড়াও পুরো  চট্টগ্রাম বিভাগে তিনি শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়ন যে বিশাল অবদান রেখে গেছেন তাঁর ফিরিস্তি এত ছোট পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে যে ধারা তিনি সৃষ্টি করে যান তাঁর হাত ধরেই বৃহত্তর অবিভক্ত চট্টগ্রামে আজকের এ অসামান্য অগ্রগতি সৃষ্টি হয়।এবং ধ্রুত শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেতে থাকে।  দূ’শ চৌষট্টি পৃষ্ঠার, ‘খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) চট্টগ্রাম জীবন ‘ প্রকাশিত গ্রন্থটি ও তাঁর রচিত আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘ আমার জীবন ধারা ‘ অধ্যয়ন করলে বৃহত্তর অবিভক্ত চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়নে তাঁর ব্যাপক অবদান সম্পর্কে  কিছু ধারণা লাভ করা যায়। চট্টগ্রামে তাঁর অসামান্য অবদান এর স্বীকৃতি স্বরুপ চট্টগ্রামের একটি সড়ক তাঁর নামে নামাকরণের জন্যে নগর পিতার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আল্লাহ পাক মেহেরবানি করে তাঁর এ নেক আমল সমূহ কবুল মকবুল ফরমান এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উঁচু মোকাম এ স্থান করে দিন, আমিন।

লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।