চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন: রাষ্ট্র, বিচার ও ন্যায়ের ভয়ংকর সংকেত

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন: রাষ্ট্র, বিচার ও ন্যায়ের ভয়ংকর সংকেত

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন: রাষ্ট্র, বিচার ও ন্যায়ের ভয়ংকর সংকেত
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মোঃ সাইফুল ইসলাম

আজকের ঘটনা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের আইনি ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থা এক গভীর সংকটে। সেই সংকটের প্রতীক হয়ে উঠেছেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস—একজন ব্যক্তি যিনি একাধারে রাষ্ট্রদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক উসকানি, সহিংসতা প্ররোচনা এবং শিশুনির্যাতনের মতো ঘৃণ্য অভিযোগে অভিযুক্ত। অথচ তাকে ঘিরে হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের সাম্প্রতিক নাটকীয়তা এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের বিচারব্যবস্থা হয় অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, না হয় কোন এক অদৃশ্য চাপে পরিচালিত হচ্ছে।

২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে চিন্ময়ের একটি সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই ঘটনায় দায়ের হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, যা কোন সভ্য রাষ্ট্রে সরাসরি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরপরও আদালত তাকে জামিন দেয়! যদিও বিকেলে চেম্বার আদালতে সেটি স্থগিত হয়, আবার সন্ধ্যায় সেই স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার করে দেন একই বিচারপতি—এত নাটকীয়তা কোনো নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অংশ হতে পারে না।

চিন্ময়ের বিরুদ্ধে আরও রয়েছে নৃশংস অভিযোগ—চট্টগ্রামে তার অনুসারীদের এক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন একজন আইনজীবী। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় তার অনুসারীরা সরকারি অনুমতি ও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একটি ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করেছে। এমন সময়, যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর দ্বন্দ্ব নতুন করে সহিংস হয়ে উঠেছে, তখন একটি অবৈধ ধর্মীয় স্থাপনার প্রচেষ্টা পাহাড়ে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারত। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কাজটি আপাতত বন্ধ হলেও, এটি চিন্ময়পন্থিদের সুসংগঠিত একটি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়—যেখানে ধর্মের আবরণে রাষ্ট্রকে বিভক্ত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি নিছক ধর্মীয় ‘উৎসর্গ’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখাই যুক্তিযুক্ত।

এমন ব্যক্তি কীভাবে জামিন পান, কীভাবে তার অনুসারীরা দেশের সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সাহস পায়—এই প্রশ্নগুলো আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ISKCON-এর শিশু সুরক্ষা ইউনিট ‘Child Protection Office’ থেকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শিশু নির্যাতনের কারণে। এটি কেবল তার চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একটি ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে সুপরিকল্পিত অপরাধী চক্রের ইঙ্গিত বহন করে।

তার অনুসারীরা ধর্মকে ব্যবহার করে বিভেদ ছড়াতে চায়। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে যেখানে তারা আদালতের জামিন আদেশকে “ধর্মের বিজয়” হিসেবে তুলে ধরছে। এটি সরাসরি বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার এবং বিচার বিভাগকে ধর্মীয় আগ্রাসনের যন্ত্রে পরিণত করার অপচেষ্টা।

আজ যদি রাষ্ট্রদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক উসকানি, সহিংসতা, এবং শিশুনির্যাতনের মতো অপরাধের পেছনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাহলে দেশে আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না। এমন বিচারপ্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের কাছে কেবল হতাশাই নয়, ক্ষোভও তৈরি করবে। যার পরিণতি হতে পারে জনআস্থা হারানো রাষ্ট্র, এবং উগ্র গোষ্ঠীর পুনরুত্থান।

বিচার বিভাগ যদি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি কেবল একটি ব্যর্থতা নয়—বরং তা একটি রাষ্ট্রের আত্মঘাতী পদক্ষেপ। পাহাড়ে শান্তির চেষ্টায় যা অর্জিত হয়েছে গত এক যুগে, তা নস্যাৎ হয়ে যাবে এই ধরনের গোষ্ঠীগত উসকানিতে। তার অনুসারীদের কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই পাহাড়ে শান্তিপ্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে।

এই মুহূর্তে চিন্ময়ের জামিন শুধুমাত্র আইনানুগ একটি প্রশ্ন নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। এটি একটি litmus test—রাষ্ট্র কী সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান এবং মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াবে, না কি চুপচাপ একটি সংঘবদ্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পতনের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেবে।

আজ আমাদের দরকার স্পষ্ট বার্তা: ধর্মের নামে রাজনীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, সহিংসতা কিংবা শিশু নির্যাতনের কোনো স্থান বাংলাদেশে নেই। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোরতা না দেখালে ভবিষ্যতে আইন-আদালত ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব—দুটোই তামাশায় পরিণত হবে।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল  কন্টেন্টের দুনিয়ায়।