"রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক” প্রাপ্ত সমাজসেবক নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরার জীবনযাত্রা - Southeast Asia Journal

“রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক” প্রাপ্ত সমাজসেবক নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরার জীবনযাত্রা

“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

ফিচার ডেস্ক

নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা (৭৪) , ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ভাদ্র মাসে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন বর্তমান গুইমারা উপজেলাধীন (তৎকালীন মাটিরাঙ্গা উপজেলার ৭নং গুইমারা ইউনিয়ন) ১৯৯নং মৌজাস্থ নারান আরবাড়ী পাড়াস্থ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কিনাচান নারায়ণ ত্রিপুরা ও মাতা মিজিং রং ত্রিপুরার সংসারে তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পিতা কিনাচান ছিলেন মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর কর্তৃক “নারান” উপাধিতে ভূষিত।

তৎকালীন বাইল্যাছড়ি মৌজাধীন পৈতৃক নিবাস নারায়ন পাড়া গ্রামে, নারায়ণ পাড়া গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবন শুরু। পিতার একান্ত ইচ্ছায় কিছুকাল খাগড়াছড়ি জেলা সদরের ঠাকুরছড়া গ্রামে পড়াশোনা করেন। অতঃপর ঐহিহ্যবাহী রামগড় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করেন ত্রিপুরা এই সমাজসেবক। জানা যায়, গৃহশিক্ষক ক্ষুদিরাম মাস্টারের (ক্ষুধিরাম ত্রিপুরা, গোমতী) কাছে অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছেন তিনি।

ছবি-১: বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের র‌্যালিতে নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা ।

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ২৯ বছর বয়সে ৭নং গুইমারা ইউনিয়ন পরিষদেের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হয়ে সমাজসেবা কাজে সরাসরি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর ধারাবাহিকভাবে একনাগাড়ে তিনি পরপর ৬ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৭৬-২০০৭) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ৩৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭নং গুইমারা ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জাতীয় উন্নয়নে বিশেষ অবদান ও সমাজসেবা কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে স্বর্ণপদক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁকে সমাজসেবায় (মরণোত্তর) সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।

ছবি-২: গুইমারা ইউৃনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরাকে দেওয়া সম্মাননা।

১৯৮৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরাজমান পরিস্থিতিতে ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীল পরিবেশ ও শান্তি পরিস্থিতি বজায় রাখার নিমিত্তে পার্বত্য ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী নেতৃবৃন্দের সরকারী বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ন্যাশনাল ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্মজীবনে তিনি সাংসারিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের প্রতিষ্ঠালগ্নে আজীবন সদস্য এবং কার্যনির্বাহী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিতসহ গুইমারা আঞ্চলিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। আর্তমানবতার সেবায় বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও উন্নয়ন সংগঠক, খাগড়াছড়ি জেলার অত্র ইউনিয়নে বহু সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন তাঁর ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার ফসল। সমাজকে একটি আধুনিক, সুশিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সৎ, কর্মঠ, নীতি আদর্শের প্রতি অবিচল সেবাব্রতে নিবেদিত ছিলেন নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা।

ছবি-৩: খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ কর্তৃক দেওয়া সম্মাননা।

বর্তমান গুইমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে বিদ্যোৎসাহী সদস্য হয়ে ১৫ বছর, নারায়ণ পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সম্মানিত সভাপতি, মাটিরাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমানে সরকারী) ম্যানেজিং কমিটির সম্মানিত সদস্য, মাটিরাঙ্গা ডিগ্রী কলেজ (বর্তমানে সরকারী) গভর্নিং বডির সদস্য এবং নিজ উদ্যোগে বাইল্যাছড়ি জুনিয়ন হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ত্রিপুরা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাইল্যাছড়ি জুনিয়র হাই স্কুলটি তিনিই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। নিজ বাড়ি থেকে একটু দূরে নির্মাণ করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ভবন ও ছাত্রাবাস।

নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা সংস্কৃতিবাদী ছিলেন। তিনি কখনই অপসংস্কৃতি পছন্দ করতেন না। কোন এক বৈসু উৎসবে তাঁর বাড়ির আঙিনায় গরিয়াদেবের পূজার্চনাকারী এক খেরেবাই দলের নৃত্য পরিবেশনাকারীরা ধুতি-রিসা-সাদা গেঞ্জি পড়ে না আসায়, তিনি গরিয়া নৃত্য পরিবেশন করতে দেননি বলে জানা যায়। তিনি নিজ মৌজায় এবং ইউনিয়নে পাহাড়ি-বাঙালি মধ্যকার শান্তি-সম্পর্ক বজায় রাখতে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। যার ফলে অদ্যাবদি স্থানীয় বাঙ্গালীরাও তাকে মনে রেখেছেন।

ছবি-৪: রাষ্ট্রপতি পদক।

কোন এক সময় বাংলাদেশ সরকার গুইমারায় পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে তিনি সেটাকে না করতে পারেননি। কারণ, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল!! কখন, কে, কাকে মেরে ফেলে, তা নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন ছিল। পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের জন্য তিনি নিজেই জায়গা দান করেন এই কারণে যে, যাতে করে অন্যদের জায়গা দখল করা না হয়। কিন্তু তাঁর এমন ভূমিকার জন্য মহাবিপত্তি ঘটেছিলো সেনসময়। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সদস্যরা বাড়ীতে এসেই পরিবারের সবার সামনেই অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় তাকে। এই ঘটনার কারণে, তৎকালীন সময়ে পুরো গুইমারা থমথমে হয়ে যায়। নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরাকে অপহরণ করে নেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল – পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনে সহযোগিতা করায় তাঁকে যে করেই হোক মেরে ফেলা হবে। কিন্তু প্রায় ১ মাস অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রাখার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

একসময় নগেন্দ্র নারায়ণ ত্রিপুরা চেয়েছিলেন নিজ গ্রাম পাকা রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন করতে, যাতে করে অত্র অঞ্চলের গ্রামবাসীদের, ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধা হয়, ব্যবসার প্রসার ঘটে এবং যানবাহন চালিয়ে হলেও যেন অর্থ আয়-উপার্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু শান্তিবাহিনীরা সেটা অনুমোদন দেননি। তাদের অভিযোগ ছিল যে, এতে করে বাঙ্গালীরা আরও বেশি অনুপ্রবেশের সুযোগ নেবে। শান্তিবাহিনীর বাঁধার কারণে তিনি আর অত্র এলাকায় রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন করতে পারেননি।

২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারীর দিবাগত রাত প্রায় ৩ টার দিকে এই মহান মানুষটি পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৭৪ বছর। তিনি ৫ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তান সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।