সে দিনের আমার অনুভূতি আর বিষন্নতার কথা এখনো মনে পড়ে

দীনময় রোয়াজা
১৯৭৫ সাল। আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি।
১৫ অগাস্ট সকালে স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম আর্মিরা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করেছে। খবরটা শুনে আমার কোমল মনে এতোই খারাপ লাগলো যে, ক্লাশে কোন কিছুই আর ভালো লাগেনি আমার। ক্লাশে ছেলে বন্ধুরা অন্যান্য দিনের মতো দুষ্টুমী করছে, খেলছে আর চেঁচা-মেচি করছে। কিন্তু আমি বিষন্নমনে বেঞ্চের উপর আমার নির্ধারিত আসনে বসে ভাবছিলাম আর আমার রাফ খাতার পাতা উল্টিয়ে দেখছিলাম। পেয়ে গেলাম রাফ খাতার মাঝখানে এক পাতা জুড়ে আমারি কচি হাতের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম! -স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ ছবিটি। বিশেষত: বঙ্গবন্ধুর এ ছবিটি সেই যে ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন চতূর্থ শ্রেণির পাঠ্য বই পৌর বিজ্ঞানের প্রচ্ছদে দেয়া ছিল এবং তা দেখে তখন আমি ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম যা’ পরবর্তীতে আমি বঙ্গবন্ধুর এ ছবিটি মুখস্ত আঁকতে পারতাম। কিছুদিন আগেও আমার এ রাফ খাতায় রাত্রে হারিকেনের আলোয় বঙ্গবন্ধুর এ ছবিটি মুখস্ত এঁকেছিলাম। কিন্তু, আমার কচি হাতে আঁকা সেই ছবিটি যদি সংগ্রহে থাকতো তাহলে আজ আমি গর্ব করে এখানেই দেখাতে পারতাম। আর সংগ্রহে রাখবো কী করে? পঁচাত্তরের পর যেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণে এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল সেখানে তাঁর ছবি সযতনে তুলে রাখা এ দুঃসাধ্য অন্তত তখন আমার ছিল না। আমরা কেউ কী ভাবতে পেরেছি যে, একদিন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসবেন? আবার আমরা বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে উচ্চারণ করতে পারবো! ‘জয় বাংলা’ বলতে পারবো?
সেই দিনের সেই ক্লাশের কথা আমার এখনো মনে আছে। আমি কী মনে করে আমার রাফ খাতায় অংকিত বঙ্গবন্ধুর সেই ছবিটি আমার এক বন্ধুকে দেখালাম। অমনি সারা ক্লাশে তোলপাড় হয়ে গেল। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ হায়! হায়! করলো আর কেউ বিজ্ঞজনের মতো বললো, দীনু মুছে ফেলো এ ছবিটি, এ ছবিটি আর এঁকোনা। সে দিন আর ক্লাশে পড়া হয় নি। দেশে মার্সা’ল জারি করা হয়েছে। তাই, হেড স্যার তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন।
স্কুল থেকে গ্রামের বাড়ী প্রায় ৩কিলোঃ দুরে, কাঁচা রাস্তার পথ। মাঝখানে খাগড়াছড়ি বাজার। বাজারেও থমথমে ভাব! প্রায় দোকান বন্ধ। অনেকে জড়ো হয়ে বেতারে(রেডিও) খবর শুনছে। অনেকে কেমন যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে। বাজারের একটি পরিচিত দোকানে আমাদের পাড়ার এক সিনিয়র ছাত্র যাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম তিনি আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। আমি তাঁকে বীরুদা বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের হাই স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণির ছাত্র। এক কথায় তিনি আমার চেয়ে অগ্রজ এবং বিদ্যা-জ্ঞানে অতুলনীয়। আমরা দু’জনে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ ধরে আমরা দু’জন চুপচাপ হাঁটতেছি। এক সময় নীরবতা ভেঙ্গে বীরুদা জিজ্ঞেস করলেন আমায়-
– কিরে, দীনু তোমার কী মন খারাপ? প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে বলে?
আমি নিরুত্তর। তাঁর দিকেও তাকাতে পারিনি আমি। বীরুদা আবার নিজের কথা টেনে বললেন-
– জানি তোমার মন খারাপ হতে পারে। কারণ, তুমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব শ্রদ্ধা করো, ভালবাসো।
কিন্তু, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এ হত্যা-কান্ডকে মানতেই হবে। কারণ, দেশের যে সমস্যা তা থেকে মুক্তি পাওয়া
দরকার। দেশে চাল নেই, কেরোসিন নেই। গ্রামের লোকেরা না খেয়ে অন্ধকারে আর কতোদিন থাকবে বলো। গত বছর
দূর্বিক্ষ হয়েছে। কোন ত্রাণ সামগ্রী নেই্। গরীবের ত্রাণ-সামগ্রী লুটপাট করে খেয়েছে সরকারের লোকজন। ব্যাংকের টাকা
লুট হয়েছে। এ অবস্থায় দেশ চলবে কী ভাবে চিন্তা করে দেখেছ? স্বাধীন বাংলাদেশ আর থাকতোনা, এ দেশ ভারতের
হয়ে যেতো ……..।
বীরুদা বলেই যাচ্ছেন। আমি কেবলই শুনছি। তবে আমি জানি যে, সব কথা তাঁর নিজের নয়। তিনি দোকানে বসে থেকে অন্যদের কথাগুলো রপ্ত করে নিয়েছেন। হয়তো বিশ্বাসও করেছেন।
– দীনু, তুমি কিছুই বলছোনা যে? বীরুদা আবার জিজ্ঞেস করলেন। আমি এবার সাহস সঞ্চার করে বললাম-
– আচ্ছা, বীরুদা তাই বলে দেশের একজন প্রেসিডেন্টকে এভাবে হত্যা করতে হয়? তাও আবার স্বপরিবারে? বঙ্গবন্ধুর দোষ থাকলে তাকে বন্দী করে তাঁর বিচার করতে পারতো, ……?
সে দিন সারা পথটা বীরুদার সাথে এভাবে তর্কে লিপ্ত হলাম। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়, অনেক কিছু জানেন। কিন্তু তবুও তারঁ চিন্তা-ধারণা ও মতের সাথে আমি এক হতে পারি নি।
বাড়ীতে পৌঁছে দেখি বাবা বেশ রাগান্বিত হয়ে মা’কে বলছে। ‘শুন আঙ্গুরবালামা, দেশ একেবারে রসাতলে গেছে। এ দেশের বাঙ্গালী জাতিরা হলো সবচেয়ে বিশ্বাসঘাটক জাতি। এরা নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হত্যা করেছে, মীরজাফর বিশ্বাসঘাটক। এই বিশ্বাসঘাটক মীরজাফরের বংশধররাই এবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার পরিজনকে হত্যা করলো। এমন কি বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট ছেলে রাসেলকেও মেরে ফেললো! …
আমি আরো হতবাক হয়ে গেলাম ছোট ছেলে রাসেলকেও মেরে ফেলেছে বলে জেনে। তাই বই-পত্র রেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম- বাবা, আপনি কী ভাবে জানলেন যে রাসেলকেও …
– ঐ যে রেডিওতে, কলিকাতার খবরে।
এ ভাবে সেদিন আমার কিশোর বয়সের কোমল মনে বিষন্নতার দাগ লেগে গেল। আমি সেদিন থেকে এই মনোভাব ধারণ করছি যে, এ বড় অন্যায়! এ বড় নিষ্ঠুর! এ বর্বর কর্মকান্ডে জড়িত পাপীদের কোন ক্ষমা নেই!