সেনাপ্রধানের ‘ফুল স্টপ’ থেকে আমি যে বার্তা পেলাম

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ
রাওয়া তে জেনারেল ওয়াকার এর দেয়া একটি বক্তব্য নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচনা চলছে। সবচে’ বেশী আলোচনায় এসেছে ‘ফুল স্টপ’ এর ব্যাপারটা। তিনি মুখে শুধু একবার ‘ফুল স্টপ’ শব্দটি উচ্চারন করলেও উনার পুরো বক্তব্যে বেশ ক’টি সাইলেন্ট ‘ফুল স্টপ’ ছিল। যেমনঃ
১ – “এই বর্বরতা (পিলখানা হত্যাযজ্ঞ) কোন সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিজিবি সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুল স্টপ (উচ্চারিত)”
২ – নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি বন্ধ করুন। ফুল স্টপ (অনুচ্চারিত)।
৩ – অপরাধীকে শাস্তি দিন, তার প্রতিষ্ঠানকে নয়। ফুল স্টপ (অনুচ্চারিত)।
৪ – ড. ইউনুস যথাসাধ্য চেস্টা করছেন দেশকে ইউনাইটেড রাখতে। উনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। ফুল স্টপ (অনুচ্চারিত)।
৫ – আমাদের ইউনাইটেড থাকতেই হবে; অন্যথায় দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। ফুল স্টপ (অনুচ্চারিত)।
প্রথম (উচ্চারিত) ফুল স্টপ নিয়েই বেশী আলোচনা হচ্ছে। এই ফুল স্টপটি যে বার্তা দিচ্ছে তা বুঝতে হলে একটু প্রেক্ষাপটটাও জানা দরকার। ৫ আগস্টের পর একটা ট্রেন্ড আমরা লক্ষ্য করেছি- বিগত সরকারের পুরো সময়টায় যারাই কোন কারনে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, প্রায় সবাই ঢালাওভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার দাবী করে শাস্তি থেকে অব্যাহতি চাচ্ছেন। পিলখানা হত্যাযজ্ঞে জেল-সাজাপ্রাপ্ত ততকালীন বি ডি আর এর সদস্যরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
কিছু মানুষ পুরো বিষয়টা অনুধাবন না করেই তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন, সমর্থন দিচ্ছেন, এমনকি তাদের মুক্তির দাবীও তুলছেন। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, নেপথ্যের দেশী বিদেশী কুশীলবদের সনাক্ত এবং অভিযুক্ত না করে এসব সাধারন জওয়ানদের জেল খাটিয়ে লাভ কি? ফুল স্টপ। জী, এখানেই থামুন। আর এগোবেন না। কারন, যাদের আপনি সাধারন জওয়ান ভাবছেন, তারা সাধারন মানুষ নয়- নৃশংস খুনি। এরা বুলেট ছুড়ে, বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে বাংলাদেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করেছে। এরা খুনি, শাস্তিই এদের প্রাপ্য, ক্ষমা নয়।
ঐ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের কুশীলব কারা এটা আজ সারা বাংলাদেশ জানে। নতুন করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেনাপ্রধান এই কমিশনকে সর্বতো সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন। যদি আমরা সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত দিয়ে কমিশনকে সহযোগিতা করি, উনাদের তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব মাস্টারমাইন্ডদের পরিচয় জানবে। বাইরের শক্তির সংশ্লিষ্টতা প্রমানিত হলে আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা করা যাবে।
আমরা সবাই মনেপ্রানে চাই, নেপথ্যের কুশীলবরা চিহ্নিত হোক, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক। কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারীরা ধরা পড়েনি এই অজুহাতে আমরা কি মাঠ পর্যায়ের খুনীদের দায়মূক্তি দিয়ে দেবো? জেল থেকে ছেড়ে দেবো? ক্ষমা করে দেবো? আমি আপনি তো ক্ষমা করার কেউ নই। শহীদদের সন্তানরা বলুক, তারা তাদের পিতার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেবে কি না। ফুল স্টপটা ওখানেই।
আমার বিশ্বাস, জেনারেল ওয়াকার এটাই মীন করেছেন।
কেন তিনি সুনির্দিষ্টভাবে এই ‘ফুল স্টপ’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেন? আসলে কি স্টপ করাতে চাইছেন তিনি? পিলখানা হত্যাযজ্ঞের বিচার? অনেকেই ব্যাপারটা এভাবেই অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। অথচ উত্তরটি তার বক্তব্যেই আছে। তিনি স্টপ করাতে চাইছেন ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, এই ইস্যু নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি হলে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। সেটা হতে দেয়া নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
কিছু মানুষ জেনারেল ওয়াকারের মুখে উচ্চারিত এই ফুলষ্টপটি নিয়ে এতো বেশী হাইপ তুলেছেন যে তার অনুচ্চারিত, সমধিক গুরুত্বপূর্ণ ফুলষ্টপ গুলো চাপা পড়ে গেছে। কেউ না বুঝে করেছেন, আবার কেউ করেছেন ঠান্ডা মাথায়, সূপরিকল্পিতভাবে।
- অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
- ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
- ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।
বাকী ফুলষ্টপগুলোতে অনেক গভীর মেসেজ আছে। স্মরণ করুন, তিনি তিন তিনটিবার বললেন, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি.. যদি আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করতে থাকি, এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। তিনি এ ও বললেন, আপনারা যেন বলতে না পারেন, আমি সতর্ক করিনি।

পরিতাপের বিষয় হলো, সমালোচকরা শুধুই জেনারেল ওয়াকারের তর্জনী দেখলো, মেসেজটা হৃদয়ঙ্গম করলো না।
আগষ্টের পরাজিত শক্তি নানামুখী অপকৌশল প্রয়োগে ব্যর্থ হয়ে তাদের সর্বশেষ মরণ আঘাত হেনেছে আমাদের তাবত শক্তির উৎস- জাতীয় ঐক্যে। ক্ষমতার লোভ, হানি ট্র্যাপ, মানি ট্র্যাপ, অসহযোগিতার প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকাশ্য হুমকি…নানা কিছু দিয়ে তারা ক্ষমতালোভীদের আনুগত্য কিনেছে। ফলে খন্ড খন্ড যে শক্তিগুলো যে স্বপ্ন এবং আদর্শকে বুকে ধরে জুলাই বিপ্লবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তারা সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অন্যের প্রতি তীব্র ভাষায় বিষোদগার করা শুরু করেছে। প্রায়ই ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বাধছে। ধীরে ধীরে আবারও আমরা সেই গতানুগতিক অসুস্থ, আত্মবিধ্বংসী রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ছি। এটাই চরম উৎকন্ঠার ব্যাপার। এজন্যেই বারবার সতর্ক করে দেয়া।
ড. ইউনুস এবং জেনারেল ওয়াকার দুজনেই ঐক্যের কথা বলছেন। আমরা সাধারন মানুষও ঐক্য চাই। প্রতিপক্ষ চায় আমাদের এই ঐক্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতে। এজন্যে তারা নানাধরনের ইস্যু তৈরী করে। ইস্যুর সমর্থনে জনমত গঠনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। সোস্যাল মিডিয়া একটিভিষ্টদের পেছনে অনেক খরচপাতি করে তারা সরকারবিরোধী নেতিবাচক বয়ান দাড় করানোর চেষ্টা করে।
জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্যের শুধু একটি অংশের অপব্যাখ্যা করে, সেটা নিয়ে হাইপ তুলে, তার অন্যান্য সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে (সতর্কীকরণ এবং ভেদাভেদ এড়িয়ে ঐক্যের আহ্বান) মাস্কিং করে ফেলার অপচেষ্টা পরাজিত শক্তিরই আরেকটি অপকৌশল।
ওদের ফাদে পা দেবেন না। সতর্ক থাকুন। শত্রু ভীষন চতুর। আমরাও একটু চিন্তাশীল হই, বুদ্ধিমান হই। যে চা ফেরী করে আর যে আইডিয়া ফেরী করে, দুজন কি সমান হতে পারে! আমরা তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইডিয়ার ফেরীওয়ালার নেতৃত্বে আছি। আমরা কিভাবে বুদ্ধি বা কৌশলে চা-ওয়ালার অনুসারীদের কাছে হারবো! লজ্জার ব্যাপার না?
-লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।