সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারঃ অতি আঁতেলদের আঁতলামি 

সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারঃ অতি আঁতেলদের আঁতলামি 

সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারঃ অতি আঁতেলদের আঁতলামি 
“এখান থেকে শেয়ার করতে পারেন”

Loading

মেজর নাসিম (অবঃ) 

“জাতে চিকিৎসক তালে সাংবাদিক “- এমন স্বনামধন্য ইউটিউবারকে সেনাপ্রধানের প্রথম আলোতে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু তীর্যক মন্তব্য করতে দেখলাম। সেনাবাহিনীকে দেশ প্রেমিক বলাতেও তার আপত্তি। আর অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনুসের সরকারকে সেনাপ্রধান আসন্ন নির্বাচনে ‘সহায়তার’ প্রতিশ্রুতি দেবেন -এটা বলাতেও তিনি নাখোশ।  তার কথা ‘উনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী -এটা উনার ‘চাকরি ‘ অতএব এটা উনার সদিচ্ছার বিষয় না।
উনার উপস্থাপনার ‘ঢং’ টা ছিলো, উনি (জেঃ ওয়াকার) আর এমন কি!!
এসব বিষয় নিয়েই আজকের লেখা।

প্রথমেই বলে নেই – যে কারো মতামত দেওয়ার বা তার তার মত করে দেখার স্বাধীনতা আছে। মোটাদাগে আমি বলবো উনি (জেঃ ওয়াকার) সব বিষয়ে ভারসাম্যমূলক এবং যুক্তিসংগত মতামত তুলে ধরেছেন।
আমার স্মৃতি বলে ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ যে রকম রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছেন এবং মিডিয়ার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জেনারেল ওয়াকার সেই রকম একটা মনযোগ পাচ্ছেন। তার প্রতিটি কথা বা শব্দ বা তার বডি ল্যাংগুয়েজ দেশের সকল মানুষের তীক্ষ্ণ মনযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে:
” দেখি না উনি কি করেন”-এমনই একটা সন্দেহ মেশানো আগ্রহ ও কৌতুহলের দোলাচালে ভুগছে দেশের অনেক মানুষ। এর এই কৌতূহলের ঢোলে বাড়ি দিচ্ছেন দেশ-বিদেশের সর্বজ্ঞানী ইউটিউবার সেলিব্রিটি। তারা সকাল বিকাল ‘এরে- তারে’ নানান দালাল ট্যাগে ঘৃনা স্তম্ভ বানিয়ে দিচ্ছেন।

কলকাতার নচিকেতার একটা গান মনে করতে চাই :
” আমি মূখ্যুসূখ্য মানুষ বাপু কিছুই বুঝি না
এই দেশের রং তামাশা কিছুই জানি না
আজকে যিনি দক্ষিণেতে কালকে তিনি বামের
আজকে যিনি তেরঙ্গাতে কাল ভক্ত রামের
কে যে কখন কার পিছনে বুঝিনা কে খাঁটি
আসলে আসলে সবাই সবার পিছনেতে সবার হাতেই কাঠি।”

আমরা বাঙালীরা খুব অস্থির প্রকৃতির জাতি। সকালের সুনামী সম রোষ বিকালে নিস্তরঙ্গ তটভূমি। আমাদের মন আসলে ষড়ঋতুর মতন। এই দেশের ঋতুচক্র আমাদের আচার-আচরণ চিন্তা ভাবনায় দ্রুত প্রভাব ফেলে। আমাদের আরেকটি জাতিগত বৈশিষ্ট্য হলো আমরা খুব স্মৃতিভোলা জাতি বা স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি নিয়ে চলি। যাকে বলে গোল্ডফিশ মেমোরি। আমাদের ঋতু যেমন দুই মাস পর পর বদলায় আমাদের মন ও আচার-আচরণ তেমনই বদলায় ঋতুর পরিবর্তনের সাথে। গ্রীষ্মের চৈত্রের তীব্র দাবদাহে মন মেজাজ তিরিক্ষি থাকে, যেই না বৈশাখের ঝড়ের পর বৃষ্টি নামতে শুরু করে মনও নরম হয়ে যায়। বর্ষায় চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুরে চৌচির মাটি নরম কাদায় পরিনত হয়। মন শ্রাবনের বৃষ্টির মত নরম থাকে আর শরতে তা হাওয়ায় পেঁজা তুলোর মত উড়তে থাকে।

কথাগুলো এজন্যই বলছি আমাদের সততা পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভংগীর জন্য। কাল যাকে মাথায় তুলে নেচেছি আজ তাকেই পায়ের তলায় পিষ্ট করছি : “তুই দালাল, তুই ভারতের দালাল, তুই পাকিস্তানের দালাল”,,, আওয়ামী দালাল, বিএনপি দালাল, জামাতের দালাল।

এখন ৫ আগস্টের “বিপ্লব” তার পরিচয় হারাতে বসেছে। ওটা বিপ্লব নয় ওটা ছিলো গণ-অভ্যুত্থান! লুকিয়ে থাকা আওয়ামী দোসরদের ভাষায়-” জামাত-বিএনপি-আমেরিকার ” চক্রান্ত!! আমরা আমাদের লক্ষ্য হারাতে বসেছি। গতকালের হিরোকে আজ দালাল, মীরজাফর বানাচ্ছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে আর কেউ বাংলাদেশী নেই, সবাই কোন না কোন দেশের দালাল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নামের আগে “দেশ প্রেমিক ” বিশেষণ যোগ করলে নাকি অন্যদের খাটো করা হয়! চিকিৎসক অন্য পেশাজীবি, সবাই তো দেশ প্রেমিক। এস আলম-সামিট-শেখ হাসিনাও তো দেশ প্রেমিক!!

আচ্ছা, আমরা সেনাবাহিনীকে শুধু সেনাবাহিনীর চাকরিরতদের সত্বা কেন বুঝাতে চাই। আজ যিনি চাকরিতে আছেন কাল তিনি থাকবেন না। যাবেন অবসরে। আগামীকাল অন্য কেউ সেনাবাহিনীতে থাকবে। “আপনাদের সেনাবাহিনী, আপনাদের সেনাপ্রধান বলে স্থায়ী কোন সত্বা নাই।” আমি গতকাল সেনাবাহিনীতে ছিলাম আজ নাই। আমি ও সেই চিকিৎসকের একই স্ট্যাটাস। সেনাবাহিনী আগামী দিনের তরুণ -তরুণীর দেশপ্রেম বা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মঞ্চ।

নিজের স্ত্রী ও প্রেমিকার নামের আগে “প্রিয়তমা” যোগ না করে কি তাকে সম্বোধন করি? না করলে কি ভালো লাগে? প্রিয়তম বা প্রিয়তমা বলে আবেগ বা প্রতিশ্রুতিকে নির্দিষ্ট করে দেই। দেশে দেশে সেনাবাহিনীকে তেমন আদুরে নামেই ডাকে সবাই। এর অন্য অর্থ হলো তুমি সেনা, তুমি দেশের জন্য সবার আগে মরবা।

সেনাবাহিনীর আগে ‘দেশ প্রেমিক ‘ বিশেষন লাগালে না লাগালে চাকরিতে কারো বেতন কমেও না বাড়েও। এটা কোন ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি না বা কালা মালিকের ‘বিচারপতি’ সম্ভাষন নয় যে গোষ্সা হবে। দেশে দেশে সেনাবাহিনী বা প্রতিরোধ যোদ্ধা দেশপ্রেমিক কিনা  তা সেখানে যোগদান করে জীবন না হয়  অঙ্গ খুইয়েই তা প্রমান করতে হয়। মিলিটারী সার্ভিসে না থাকলে দেশকে চেনা যায় না, তা আপনি যত বড় পন্ডিত বা বিদ্বান হউন। আর লক্ষ ফলোয়ারধারী ইউটিউবার হোন।।

যুদ্ধের ময়দানই  আপনাকে দেশ চেনায়। সেজন্যই অনেক দেশে সামরিক প্রশিক্ষন বা খন্ডকালীন সেবা বাধ্যতামূলক।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কারো কারো মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, এটা কেন করেনি-ওটা কেন করেনি। দেশ ও জাতির চরম দুঃসময় ও দুর্যোগে দেশের সেনাবাহিনীই সামগ্রিক ভাবে দেশের মানুষের পাশে থাকে। তারা First Responder।  দেশের দূর্যোগের সময় তরুণ তরুণী এতে যোগ দেবে, ঝাঁকে ঝাঁকে মরবে। আবার নতুন দল যাবে সে শূন্য স্হান পুরন করতে।

সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারঃ অতি আঁতেলদের আঁতলামি 
মেজর নাসিম (অবঃ) 

হ্যাঁ গত পনেরো বছরে স্বৈরশাসকের আজ্ঞাবহ দাস নেতৃত্বের কারনে সেনাবাহিনী তার প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই বাহিনী তার কিছু কুলাঙ্গার এর কারনে তার ভাবমূর্তিকে জনগণের জন্য হতাশাজনক করে তুলেছিল। সবাইকে মনে রাখতে হবে সেনা তার নিজস্ব আইনে কঠোর কমান্ড অনুসারে চলে। তার ব্যত্যয় হলে কোর্ট মার্শাল এবং ফাঁসি। তার উচ্চ আদালতের সুরক্ষা নেই। তাই সেনাবাহিনীর সদস্য কেউ কিছু বললো আর শাহবাগে বসে পড়লো তেমন নয়। যে কোন গণআন্দোলনের প্রতিক্রিয়া বা তার ঢেউ সেনানিবাসেও পড়ে। এরকম ১৯৭১ সালেও বাঙালী সৈনিকদের মধ্যে পড়েছে তার পর কি হয়েছে সে তো এখন ইতিহাস। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে তারই নিয়োগকৃত জেনারেল নুরুউদ্দীন যখন তাকে সাপোর্ট করতে অস্বীকৃতি জানান তখনই এরশাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ২০২৪ এ একই রকম ঘটনা ঘটলো। অতএব আমরা জানি এই দেশের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী বা সেনাপ্রধান ক্ষমতার কোন ভরকেন্দ্রে অবস্থান করেন।

তিনি যে কোন এলে-বেলে বা মামুলী ‘ প্রজাতন্ত্রের কর্মী ‘ নন, তা কিন্তু প্রমানিত। তাই ‘অর্ডার অফ প্রিসিডেন্সে’ তাকে যতই পিছনে ফেলতে চাই না কেন বর্শার ফলা কিন্তু ‘তিনি’ তার ‘সদিচ্ছার’ বনাম ‘কুইচ্ছার মাশুল জাতিকে দিতে হয়।
‘আমি তো আদেশ পালন করি মাত্র’- এই রকম ‘গোঁ’ ধরে থাকলে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে উড়াল দিতো না। ‘জনগণ সেনাবাহিনীকে বাধ্য করেছে ‘ কোন কোন বাম এমন কথা বলবেন। তাতে ক্ষতি কি বা অসম্মান কি? আবাল, বৃদ্ধ, জনতা যখন রাজপথ প্রকম্পিত করতে থাকে সেই কম্পন রাজপথে দাড়ানো সৈনিকের বুটের ভিতর দিয়ে তার হৃদয়েও আলোড়ন তুলে, এ আলোড়ন তার বুকে যেয়ে তাকে দেশ প্রেমিক করে তুলে- তখনই তাদের নেতা বলে “We Revolt ” বা ম্যাডাম আপনার জন্য “৪৫ মিনিট সময়” আছে।

দেশের একটা বিশেষ সময়ে বা ক্রান্ত লগ্নে অন্য সময়ের ‘৪০০’ টাকার মেজর বা সেই ইউটিউবজীবি চিকিৎসকের ভাষায় ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ উত্তাল ঢেউ’র উপর ভর করে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। উত্তাল ঢেউ যখন না থাকে তখন আমরা দেখি ‘কদমবুসি ‘করা দুই বেলা ভাতখোর সব ‘All The Prime Minister’s Men’!!

সেনাবাহিনীকে দেশপ্রেমিক, পুলিশকে জনগণের বন্ধু, চিকিৎসককে মানবতার সেবক আর দূর প্রবাসে বসে ইউটিউবে চরমপত্র পাঠকারীকে দেশপ্রেমিক বললে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে  কোন কিছু কমবে না। তিনিও দেশপ্রেমিক। তবে ‘দুষ্টু’ লোকেরা বলবে প্রবাসী দেশপ্রেমিক, এই যা!!

আসুন সবাই সবার হাতের কাঠি ছুঁড়ে ফেলি, দেখবেন সবাই দেশপ্রেমিক।।

  • অন্যান্য খবর জানতে এখানে ক্লিক করুন।
  • ফেসবুকে আমাদের ফলো দিয়ে সর্বশেষ সংবাদের সাথে থাকুন।
  • ইউটিউবেও আছি আমরা। সাবস্ক্রাইব করে ঘুরে আসুন ডিজিটাল কন্টেন্টের দুনিয়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *